1. লাল শালুর গামছাটা মুখে দিয়ে শুলে রোদ লাগে না অত। পা গুটিয়ে সামনের সিটেই শুয়ে ছিলাম, গামছা মুখে, এমন সময় দমাদ্দম ধাক্কা। “ওদাদা। ওদ্দাদা!” ভেবেছিলাম মটকা মেরে পড়ে থাকলে আপদ বিদেয় হবে, কিন্তু তা আর হল কই? গামছা সরালাম। একটা বাচ্চা মতো মেয়ে। ঘামছে দরদরিয়ে। “খিদিরপুর। যাবে?” কে খিদিরপুর কোথায় খিদিরপুর খানিক গুলিয়ে গেল। কাঁচা ঘুম ভাঙালে ও’রকম এট্টু আধটু হয়। ভুরু কুঁচকে বললাম “যাবে না।” মেয়েটা কিছু না বলে পিছনের দরজাটা খুলে ঢুকে বসে গেল। “খিদিরপুর। পরীক্ষা। লেট। ফেল।” বলে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আমি অগত্যা চাবি ঘুরিয়ে ট্যাক্সি স্টার্ট দিলাম।

2. ঘরময় ধ্বস্তাধ্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। ভয় লেগে গেল। “রিমাআআআ?” উত্তর নেই। টেবিল চেয়ার ওল্টানো। ফুলদানি মেঝেতে ছত্রাখান। একটা টিউবলাইট পর্যন্ত ভাঙা। সাবধানে পা ফেলে এগোতে হচ্ছে। বাইরের ঘর থেকে আবার ডাকলাম, “রিমাআআআআ, কোওওওথাআআয়?” এবারও উত্তর নেই। ওর শোবার ঘরের দরজার পাল্লাটা অল্প ফাঁক করা। ভিতরে ঢুকে থমকে যেতে হল।

খাটের উপর একটা চেয়ার। চেয়ারের উপর হাফ প্যান্ট পরে হাতে চটি নিয়ে মেয়েটা নিথর হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে আটকানো। তাকিয়ে দেখি একটা এইটুকুনি মাকড়সা সন্ত্রস্তভাবে পায়চারি করছে।

3. অচেনা পাড়া। তাই অচেনা কুকুর। তাদের দাঁত থেকে ঠিকরে পড়ছে ল্যাম্পপোস্টের আলো। তারা এক পা করে এগোচ্ছে আমার দিকে। আমি তাদের দলপতির চোখ থেকে চোখে না সরিয়ে পিছু হাঁটছি। পথবাতি ফিকে হচ্ছে। কলকাতার উত্তুরে বাড়িগুলো ঝুঁকে পড়ছে। শ্বদন্তগুলো বাড়ছে কি? চাঁদটা একটু অস্বাভাবিক বড় না? চাঁদের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ সরে গেল, কিছু একটাতে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। মাটি ছোঁবার আগে দেখতে পেলাম বিশালাকায় কুকুরটা শূন্যে।

জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলাম মুখের খুব কাছে আরেকটা চশমা পরা মুখ। “আপনি ঠিক আছেন, দাদা?” ভীত গলায় হ্যাঁ বললাম। ভদ্রলোক আমারই বয়সী। আমায় টেনে তুললেন। জামা ঝাড়লুম। কুকুরগুলোর পাত্তা নেই। চাঁদটাও মেঘের আড়ালে বোধহয়। ছেলেটি আমায় এগিয়ে দেবার প্রস্তাব দিলো। সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। বিশদে ব্যাখ্যা করছিলাম একটু আগের ঘটনা, তারপর রাস্তায় নিজের মৃদু ছায়া দেখতে পেয়ে খটকা লাগল। মাথা তুলে দেখি মেঘ সরে গেছে। ছেলেটির হাত চেপে ধরতে গেলাম। “ওই যে। দেখুন, কখনও দেখেছে-” হাত হাওয়ায় ফস্কে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পেলাম শুধু।

4. মন থেকে বেরোচ্ছে না দৃশ্যটা। মুখটা। আর্তিটা। কাকুতিটা। বেচারা। বাসের জানালায় বসে ছিলাম। সাদার্ন অ্যাভিন্যুর সিগনালে আটকে ছিলো বাসটা। ফুটপাথে খুব সাধারণ কিছু মুখ, পোস্টার। আর গড়াগড়ি খাওয়া একটা আইসক্রিম কোন। আর সেটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ভগ্ন হৃদয় ক্লাস এইটের একটা ছেলে। ভারী মায়া তার মুখে। বড় মায়া।

5. Saturdays aren’t the busiest of my days. But then are none of the others. See, that’s the perk of being a station-master of a tiny halt station in the middle of nowhere. After you wave the green flag for a bit and see the ancient, exhausted, sluggish freight train off on its way, you get to lean back on your chair and light one up. No more trains of any kind till late in the evening. This Saturday wasn’t an exception. Or was it? Halfway through my cigarette, someone knocked on my door. I was almost sure that I had misheard. This is a halt station, to pass trains in an otherwise one-way track. No one gets down here. No one waits for a train. Leaving me conveniently alone. But there it was again. A hesitant knock. I opened the door.

It was a bald stranger with a towel over his head. “Kann ich etwas Wasser?” I had no clue what he was saying. I pouted and shrugged. “Water” he said, “Can I have some?” “Sure”, I said. “Come in.” The guy rested for a bit. Chugged in a gallon of spring water. And spoke. ” I am lost.” I was tempted to reply “I can see that”, but before I could, he started again. “I am lost. I am German. Which country is this?” This startled me. How lost does one have to be to end up in India from Germany without knowing? “I was at my home last night. I woke up beside the rail tracks today night. How did I come here?”

6. একশো চল্লিশের টা আড়াইশো তে বেচছি। রাজভবনের সামনে পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। কোথায় করছে না? তারই মধ্যে টুকটাক বিক্রিবাটা হচ্ছে। ধপাধপ উড়েও যাচ্ছে। আমার ভাল্লাগছে। আবার ভাল্লাগছেনা। ভিতরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। যাবে, পোস্তা থেকেও। শেওয়াগ। আকাশ চোপড়া। দু’শো তে বেচে দিলাম দুটো। ধুর। অনেকক্ষণ ধরে রাস্তার ওপার থেকে একটা মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ইতস্ততঃ। এই দৃষ্টি আমি চিনি। কিন্তু কিছু করার নেই। বেওসা।

লাঞ্চ হবো হবো। সঞ্জয় বাঙ্গার আউট। চার ডাউন। প্রথমের গাধাদু’টো। শচীন নাকি আউট ছিলো না। ব্যাট-প্যাড, তবু এলবি দিয়েছে। হারাধনের ছ’টা উইকেট বাকি। আমার বাকি দু’টো টিকিট। একপিস মামা হেঁটে আসছে এদিকে। রাস্তা পেরিয়ে নিলাম। পেরিয়েই মুখোমুখি হয়ে গেলাম মেয়েটার সাথে। চোখে জল। ইডেনের বাইরে কান পাতা যাচ্ছে না। “দ্রাবিড় এখনও আছে?” কান থেকে ইয়ারফোন খুললাম। “হুঁ। দাদা নামল। চল।”

7. উবু দশ কুড়ি তিরিশ চল্লিশ …

একশো অবধি গুনে হাত সরালাম চোখ থেকে। একতলায় এক ডজন বাবা মা আড্ডা মারছে। নিয়ম, সেখানে লুকোনো যাবে না। চোর হবার একটা নেশা আছে। একটা বুক ধুকপুক। হুশ দেবার উত্তেজনা। ধাপ্পা খাবার ভয়। ব্লাফ। কাউন্টার ব্লাফ। পর্দার তলায় কার পা দেখা যাচ্ছে। স্বর্ণাভ? হুশ! শাবাস তোপসে! সিঁড়ির তলায় পাম্পের ঘর। সেখানে কেউ না কেউ থাকবেই। একাধিক ও থাকতে পারে। গল্প হচ্ছে যে কে? বা কারা? সোজা নেমে গেলে এক্সপেক্টো ধাপ্পাম। রেলিং থেকে জিরাফের মত ঘাড় বাড়িয়ে স্মিতার স্কার্টের হেম আর অঙ্কুরের চপ্পল চিনতে পারলাম। খুঁটিনাটির দিকে নজর রাখা জরুরী। এবার অপারেশন চিলেকোঠা।

দোতলা পার হবার মুখে ল্যান্ডিং এ ডাঁই করে রাখা আলমারিটা থেকে একটা আওয়াজ এলো। দিস ইজ ট্রিকি। আলমারির গায়ে আয়না। সেখানে নিজেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে দেখছি। দরজা খোলার আগে জানতে পারব না ভিতরে কে। আর দরজা খুললেই অবধারিত ধাপ্পা। অতএব নো হুশ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। তপেশ, ভাবো। ঝুলঝাড়ু! সাত ময়লা। তার ডগা ধরে আগা টা আলমারির হাতলে ঢুকিয়ে টানলাম। অন্ধকার অনাবৃত হল। কেউ নেই। তবে?

কেউ তো আছে। একটু সাহস করে এগিয়ে উঁকি মারলাম ভিতরে। বড্ড অন্ধকার। আর অনেকটা জায়গা। একটু বেশি ই জায়গা না? দড়াম করে দরজা টা বন্ধ হয়ে গেল পিছনে। কেউ আছে ভিতরে। কেউ আছে!

বাঁ পকেটে অশোক কাকুর লাইটার টা আছে। আছে, কারণ আমার হাতটান এর দোষ আছে। আর লাইটারটা সুন্দর। ঢাকনা খুললে ফর এলিস বাজে। বাজল। শিখা জ্বলল। মুখ দেখতে পেলাম। পানপাতা মেয়ে। হাসছে। এ মুখ “এই ছেলেটি খাটিয়া চোর” বলার সময় ছিলো না। এ মুখ চিনি না। কিন্তু খুব চেনা। “কতদিন ধরে লুকিয়ে আছি বল তো?” তার ঠাণ্ডা হাতটা আমার গাল ছুঁল।
“ধাপ্পা।”

8. “আওন্দবাজার আর পড়া যায় না মহাই।” আমি আনন্দবাজার পড়ছিলাম। পড়ছিলাম না। খুলে বসেছিলাম। আমার মাথায় একত্রে একাধিক চিন্তা চুলোচুলি করে। ভিতরের আওয়াজ ই সবচাইতে বড় শত্রু। তাকে বাইরের আওয়াজ দিয়ে বিষক্ষয় করতে হয়। হোয়াইট নয়জ। আনন্দবাজার। স্টেশনের কোলাহল। বেশ কষিয়ে চিন্তা করা যাচ্ছিল, এমন সময় “কোনও কাগজই আর পড়া যায় না। উচ্ছন্নে গেছে মিডিয়া। এর পরকীয়া তার বুকের ছবি হেঁহেঁ এ’সব কি খবর?” কেঠো হাসলাম। ভদ্রলোক জুটের কোট পরেছেন। একটা আকাশি ফতুয়ার উপর। ধুতি। খয়েরি পাম্প শু। অন্য দশকের আমদানী। যত্তসব। আনন্দবাজারে মন দিই।

“খবর যদি চান তো আমি দিতে পারি।” এবার তাকাতে হ’ল।
“মানে?”
“আপনার ডান পকেটে যে কলমের মত জিনিসটা নিয়ে ঘুরছেন মিহিরবাবু, তার খবর। খুঁজছিলেন তো?”
নিজের অজান্তেই হাতড়ে নিলাম পকেট। “আমার নাম-?”
ভদ্রলোক একটা একপেশে হাসি দিলেন।
“তার আগে আমার পরিচয় টা দিই। দাস। ঘনশ্যাম দাস। আপনার কাছে সিগারেট হবে?”

9. একশো বাষট্টির পরের বাড়িটা একশো ঊনসত্তর। তেষট্টি খুঁজে পেতে ওই মাথা অবধি যেতে হল। জাঁদরেল সবুজ রঙের গেট। তোরণসম। তাতে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। হাজার ধাক্কিয়েও যখন লাভ হল না, হুড়কো খুললাম। একটা অতিকায় কুকুর ছুটে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কুকুরদের কি কোনও রামনাম হয়? পাভলভ পাভ্লভ বিড়বিড় করছিলাম, তাতে কাজ হল বোধহয়, কুকুরটা কামড়ালো না। আমায় প্রদক্ষিণ করে তিনশো ষাট ডিগ্রীতে শুঁকল। তারপর আমার হাত চাটতে আরম্ভ করল। আমি মাথায় হাত বুলোতে যাবো, ওমনি কোত্থেকে “বাওয়াল? বাওয়াল!” বলে একটা মেয়ে চিল্লিয়ে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো। ” বলেছি না অচেনা লোকজন কে চাটবে না? হাতে কত জার্মস থাকে জানো?” বাওয়াল মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে মালকিনের কাছে ফেরত গেল। আমার হাতে গতরাতের ঘুগনির গন্ধ ছিলো। বেচারি। মালকিন আমার দিকে তাকিয়ে বললে “আপনি ভিতরে আসুন, মাসি কে ডেকে দিচ্ছি।” গেটে বোনঝি হইতে সাবধান লিখে রাখা উচিৎ ছিলো।

কাউচটা নিঃসীম। ওতে বসলে পিছনে লাভার ছ্যাঁকা লাগতে পারে। ওতে একবার বসলে ওঠা অসম্ভব। আমিও তলিয়ে গেলাম। বাওয়াল এর ভুরু আছে রীতিমতো! অবশ্য কুকুরদের ভুরু থাকাটা কি রীতির মধ্যে পড়ে? সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। এ গবেষণা পরেও চলবে। আগের কাজ আগে। বাদামীর উপর লাল জরির কাজ করা একটা শাল জড়িয়ে যিনি নামলেন তিনি ই… ? আমি কেমন স্যার ক্লাসে ঢুকল, এমন ভাবে দাঁড়িয়ে গেলাম।
“ওরে! বোস। বোস। ডিম্পাউরুটি খাবি?”
বাওয়াল আর আমি একসাথে ঘাড় নাড়লাম।
ইনিই ই।

10. আমার সাইকেলটা কীভাবে বটগাছের মাথা থেকে আবিষ্কৃত হল, সেটা বলতে গেলে আগে ত্রিলোকবাবুর কথা বলতে হবে। ভদ্রলোক আমার প্রতিবেশী। গবেষক বলে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন। আমি সে’টা নিয়ে ঠাট্টা করি বলে আমার উপর খানিক খাপ্পা। তবু আমাকেই তার চাই তার নিত্যনতুন আবিষ্কার দেখাতে। থাকেন আমার বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি পরে, উশ্রী নদীর ধারে। আগে শুনেছি মিসিসিপি নদীর পারে এক ল্যাবোরেটরি তে কাজ করতেন। তা কার্তিক মাসের একটা মঙ্গলবারে সে ভদ্রলোক আমার দাওয়ায় হাজির, আমার সাইকেলটা তাকে ধার দিতে হবে, জরুরী দরকার। আমি নাচার, অচেনা অজানা একটা উটকো লোককে খামোখা সাইকেল ধার দিতে যাবো কেন? সে কথা বলাতে ভদ্রলোক ঈষৎ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন। “আমার নাম প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। গুগল করে নিন, পেয়ে যাবেন।” বোঝো! এদিকে তখনও Google এ আমার নিজের নাম লিখে search করলে শুধুই facebook profile টা দেখায়।

11. একশো একাশি জাগতিক দিবস। রপুন্দিব গ্রহের হিসেবে পৌনে দুই বছর। পৃথিবীর অধিবাসীরা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি মেয়েটা ভিনগ্রহের। সে বিশেষ কথা বলে না। এ গ্রহের ভাষা আয়ত্ত করতে তার খানিক সময় লাগছে। তবে আস্তু জানে যে মা বলে লোকটার কাছে খাবার পাওয়া যায়। খাওয়া জরুরী। বাবা নামের বেধড়ক বাজে, কেবল চটকায়। ঘাড়ের নিচের স্প্রিং টা খুলে বেরিয়ে আসছিল আরেকটু হলে। এ গ্রহের লোকজন এমনিতেই বৃহৎ, এ আবার তাদের মধ্যেও বিশালাকায়। রপুন্দিবেবাসীদের শুধু মাথায় চুল হয়। এদের সর্বাঙ্গে… দাদা নামে একটা ছোটখাট লোক আছে। তারা ভৃত্য প্রকৃতির। যা বলে শোনে। ঘাড়ে চেপে ঘোরা যায়। পছন্দ না হলে মোড়ার ঠ্যাঙ দিয়ে ঘা কতক দিয়ে দিলেও রা কাড়ে না।

দিন একশো চুরানব্বই। বাড়িতে একটা যন্ত্র এসেছে। এ যন্ত্র রপুন্দিব গ্রহে নেই। যন্ত্রটা চালালে ভিতর থেকে… একী! এ তো রপুন্দিবের বাসিন্দারা! তাদের কে একটা বেবি খাটের মধ্যে… তারা যন্ত্রের ভিতর কী করে…? আস্তু বুঝল বেজায় বিপদ। গ্রহবাসীদের মুক্ত করতে হবে। আর তাছাড়া এ’রকম চললে তার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে যাবে!

দুই বছরের মেয়েটা একটানে দড়াম করে টিভিটা মাটিতে ফেলে দিলো।

12. আমি বর্তমানের মতো। ভগবান আর ভূগোলের ম্যাম ছাড়া কাউকে ভয় করিনা। ভগবান লোকটা, বলতে নেই, হাড়ে ইয়ে। নক্সাবাজ লোক। মিথ্যুক। আর ভূগোল ম্যামের রিডিং গ্লাসটা নাকের ডগায় নেমে এসে পড়ব পড়ব করেও পড়ে না। বই বা খাতা দেখবার সময় সেটা টেনে চোখের কাছে উঠে আসে। নইলে…

ম্যাম পড়া ধরেন। কিন্তু না পারলে বেঞ্চিতে দাঁড়াতে হয় না। তার একটা কারণ দাঁড়ালে মাথা পাখায় লেগে যাবে। শিরশ্ছেদ। নিদেনপক্ষে আলু। নয়ত একগাছি চুল। না পারলে ক্লাসের বাইরে বের ও করে দেন না। বেত নিয়েও আসেন না। এইজন্যেই ভয় করে। মতলবটা কী ওনার? এই যে পড়ে না এলেও চাপ নেই ব্যাপারটা, এ’টা নির্ঘাৎ ফাঁদ। চারপাশের অদৃশ্য জালটা খোঁজার চেষ্টা করছি এমন সময় Somdeb বেমক্কা হাত তুলে বলে দিলো কিউমুলাস আর কিউম্যুলোনিম্বাসের তফাৎ। ওর কান যদি না মুলাসিয়েছি…

মহিলা প্রসন্ন হলেন। উত্তর-পশ্চিমের জানালাটার দিকে আঙুল তুললেন। “ওই যে। কিউমুলাস।” আজব। এই মেঘগুলো আসল? ভিস্যুভিয়াস, কিলিমাঞ্জারো আসল? জুলিয়াস সিজারের মতো অবলুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক ঠাকুরমার ঝুলির বুলি নয়? ষাটখানা মাথা ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁ করে জীবনে লক্ষবার দেখা মেঘটাকে নতুন করে দেখতে লাগল। হুঁ। ভূগোলের ম্যাম আসল। ভয় পাই।

13. উত্তরদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। কনকনে হাওয়া বইছে জোরে। বরফের কুচি চোখে ঢুকে যাবে। আঙুলে ব্যথা করছে। ঠোঁট ফেটে গেছে এর মধ্যেই। পাঁচিলের উপর থেকে অনেকখানি দেখা যায়। উত্তরে। দক্ষিণে। নিষ্পত্র গাছগুলো ঘোলাটে সাদার মধ্যে খয়েরি হয়ে দাঁড়িয়ে। কয়েকটা কাক ওড়াউড়ি করছে এদিক ওদিক। তাছাড়া প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই। দাঁড়িয়ে লাভ যে নেই, আর দাঁড়িয়ে থাকলেও যে তার ফেরার সম্ভবনা বাড়বে না, সে কথা মেয়েটা বোঝে, জানে। মানতে চায় না। পিছনে ঠায় নীরবে অপেক্ষা করে থাকা প্রৌঢ় মুখ খুললেন। “এবার কি নীচে নামা উচিৎ নয়?” মেয়েটা মুখ ঘোরালো। কেবল এইটুকুতেই কত আরাম, হাওয়াটা মাথার পিছনে, কানে ধাক্কা দিচ্ছে এখন। মাথা উপরনীচ করে সম্মতি জানাল সে, আর প্রৌঢ়র কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় দেখে থমকে গেল। উত্তরদিকে মুখ ফেরাল মেয়ে। একটা ঘোড়া না? পিঠে ওটা… ওটা কি…?

14. অনেকক্ষণ ধরে একটা সাদা রঙের গন্ধ পাচ্ছিল মেয়েটা। ঠিক সাদা নয়, সাদা আর সবুজ মেশানো, সবুজটা একটু কম। এখন আবার একটা ছাই রঙা গন্ধ যোগ হল। এই দ্বিতীয় গন্ধটা একটু গরম। আরেকটু ভালো করে শুঁকতে পেতো, যদি না কানের গোড়ায় তুলো গোঁজা থাকত। তারপর দেখলো কে কাকে বলছে “রজনীগন্ধাগুলো বাসি হয়ে যাবে, সরাও, আর ধূপকাঠির ছাই পড়ছে নিচে…”

15. মাথা নিচু। চিবুক বুকে ঠেকানো। তাই চোখ কালো বুটের ডগায়, যেখানে অজস্র আঁচড়। “তোমায় তো শান্ত ছেলে বলে জানতাম হে? বাধ্য ছেলে? শেষে তোমার এই রূপ?”

আর্যর কোর্ট মার্শাল হচ্ছে। গোটা ইস্কুল ভিড় করে দেখছে। হেডমাস্টার আর্যর হাত পিছমুড়ে বেঁধে কথাগুলো বললেন। আর্য মুখ তুলে হাসল। মাস্টার পিছিয়ে এলেন। ফায়ারিং স্কোয়াডের পিছনে। বন্দুকের মুখের বেয়নেটে সকাল আটটার সূর্য ঠিকরাচ্ছে। আর্যর নীল সোয়েটার ভেদ করছে পশ্চিমী একটা হাওয়া। কুয়াশা তাতে এলোমেলো হচ্ছে না। আর্যর চুল হচ্ছে। পিছনের কার্পাস গাছটায় হেলান দিলো আর্য। স্কুলের হলুদ বাড়িটা বড় উজ্জ্বল লাগছে। আর্যর কর্ণেল হোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়ার কথা মনে হল। জীবনের অন্তিম লগ্নে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে মানুষটার বাবার হাত ধরে বরফ দেখতে যাবার কথা মনে পড়েছিল। আর আর্যর একটা উপন্যাসের চরিত্র মনে পড়ছে? তার লড়াই না, বিদ্রোহ না, মা বাবা না, শহর না… মাকন্দ নামে একটা মনগড়া গ্রামের কোন এক বুয়েন্দিয়া?

16. বেওয়ারিশ। অজ্ঞাত। আঙুলের ছাপ সিস্টেমে নেই। ডিএনএ তথ্যভাণ্ডার এ দেশে রাখা চালু হয়নি। মুখ দেখে শনাক্ত করা যেত, কিন্তু শহরের যাবতীয় “আমাদের মেয়ে বাড়ি ফেরেনি” মা-বাপ এসে বলে গেছে এ মেয়ে তাদের নয়। শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। রক্তে বিষ নেই, ফুসফুসে জল নেই। হৃদরোগ নেই। মাথায় স্ট্রোক হয়নি। ময়না তদন্ত বলছে স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে। মানে হৃৎপিণ্ডটা চলছিল, পট করে বন্ধ হয়ে গেল। লাশ পাওয়া গেছিল সাদার্ন এভিন্যুর কাছে একটা গলিতে। রাস্তার উপরে কিছু ইস্তিরিওলা বসে না? ঠেলাগাড়ির উপরে ইস্তিরি করে? ও’রকম একটা গাড়ির উপর। মাথার তলায় হাত দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়েছিল। ইস্তিরিওলা সকালবেলা উঠে পড়েছে বেজায় সমস্যায়। তারপর লোক, লস্কর, ভিড়, ভাট্টা, টোন, টিটকিরি, পুলিশ, টুলিশ, “হামি কুছু জানে না বাবু।” এখানে গোয়েন্দাবাবুর খট্‌কা লেগেছিল। একটা আপাদমস্তক বাঙালি ইস্তিরিওলা বিহারী বাংলায় কথা বলছে কেন। উত্তরে সে বলেছিল “হামি কুছু জানে না বাবু।” সে যাই হোক। মোটকথা এনআরএস মর্গে বডি আছে, যদি আপনাদের কিছু হদিশ থাকে…

17. সেই চোখ। সেই ভুরু। মিলিয়ে নিলাম ছবির সাথে। কোনও তফাৎ নেই। হুবহু। সেই পাট করে আঁচড়ানো চুল, আধা ফ্রেমের চশমা। এই। এ ই। “দাদা শুনছেন?” পিছন ফিরে তাকালো। “আগুন হবে?” বোকাবোকা প্রশ্ন। এ ঠোঁট এখনও স্ট্র দিয়ে থাম্বস আপ খায়, সিগারেট ছোঁয়নি। “কিছু বললেন?” “বলছি আগুন হবে?” ছেলেটা পকেট হাতড়ে একটা লাইটার বের করে জ্বালিয়ে ধরল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে প্যাক থেকে সিগারেট বের করে মুখে নিলাম। হিসেব মিলছে না। “দাদা কি কলেজে পড়ান নাকি?” মাথা নাড়ল। মিলছে। হাঁটা লাগাল ফের। আমি পিছু ধরলাম। সামনের মোড়েই ভ্যান আর অতীশ আর সন্টু আছে। রুমালটা বাঁ পকেট থেকে ডাইনে নিলাম। সঙ্কেত। এইবার।

18. বাসস্টপ থেকে নেমে ফুটপাথ ধরে উত্তরে। আরামবাগ। দু’চারটে এলেবেলে দোকান। শিশির স্টুডিও। একটা দেওয়াল। মনজিনিস। ডানহাতের গ- একমিনিট। দেওয়ালে পোস্টার। কোনও একটা সিনেমার। নায়িকা বেশ দেখিয়ে টেখিয়ে… কিন্তু ওতে বড় বড় করে আমার নাম কেন? কাছে এগোতে হল। বাস্তবিক ই আমারই নাম। তলায় আমার ফোন নম্বর দেওয়া। ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? এদিক ওদিক তাকাতে দেখি খচ্চরটা, মোবাইল এ আমার ছবি তুলছে। দ্রুত পায়ে তেড়ে গেলাম, কিন্তু দৌড়ে ওর সাথে পারা দুষ্কর। অলিভার ট্যুইস্ট কে ব্যাগ অফ বোন্‌স বলে বিশেষিত করেছিল একটা চরিত্র। তার শরীরেও এর চেয়ে বেশি গত্তি ছিল বোধহয়। পিছিয়ে এসে পোস্টারের আমার নাম লেখা অংশ ছিঁড়তে হলো। রাগে গজগজ করতে করতে। ছবি যেটা তুলেছে, না জানি কী কুকর্মে লাগাবে। পাজির পাঝাড়া। আমায় হেনস্থা করতে পারলে আর কিছু চাই না ওর। কী কুক্ষণে যে ও আমার যমজ হলো…

19. ভদ্রমহিলা ছাতাটা বন্ধ করেছিলেন। বৃষ্টি ছিলো না। চাঁদিফাটা রোদ্দুর। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোর জমায়েতে আগমন। ছাতার নিরুদ্ধি। চীনে ফোল্ডিং ছাতা নয়। কালো লম্বা ছাতা। এতক্ষণ মহিলা তার ছেলের সাথে গুজগুজ করছিলেন। বছর দশ বারোর ছেলে। বোলিং অ্যাকশন এর শ্যাডো করে চলেছে। বক্তব্য শুনতে পাইনি। মনে হল সওয়াল জবাব। তারপর অটো এলো। ছাতা বন্ধ হলো। হাত উঠল মাথার উপর। অমোঘ খাঁড়ার মত নেমে এলো ছেলের মাথা লক্ষ্য করে। ছেলে বাউন্সার ডাক করার কায়দায় মাথা সরিয়ে নিলো। আমার অটোর সামনের কাঁচটা ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল। আমি বিড়ি ফেলে ছুটলাম। ” অমন মারেন না বৌদি, কাঁচ গেসে মেরামত করে নেবোখন, মাথাডা গ্যালে কী অইব কন তো?”
মোদ্দা কথা আমি আজকাল হেলমেট পরে অটো চালাই।

20. ঘন্টাই কারুর সাথে শুতে গেলেই অনর্থ ঘটে। এমনিতে ছেলে ভালো। ছুঁকছুঁকানি বাতিক নেই। অকম্মা নয়। দিব্যি চাকরি বাকরি করে। শনিবার শনিবার
হাল্কা ঢুকুঢুকু করে ক্যারিওকি তে গান করে। মাঝেমধ্যে কী গোয়াটা কী কুর্গটা ঘুরে আসে। মাঝেসাঝে এক দু’টো প্রেমট্রেম। কিন্তু শুতে গেলেই অনিষ্ট। ওইতো, মাস তিনেক আগে, বেঙ্গালুরুতেই, সোফার উপরে শবাসনে উপনীত হয়েছে কি হয়নি, ফ্ল্যাটে গেল আগুন লেগে। মানে পাশের ফ্ল্যাটে। ধোঁয়া টোয়া দমকল টমকল বিশ্রী কাণ্ড। ঘন্টাই প্যান্ট পরে না প্রাণ বাজায়… সে প্রেমটা জমছিল দিব্যি, দুধে চোনা পড়ার মত কেটে গেল। তারপর এই গত হপ্তায়। কলকাতায়। বাড়ি ফিরেছিল কিছুদিনের জন্য। এক পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা। তারপর কথায় কথায় সাক্ষাৎ। ওমা! ভূমিকম্প! ঘন্টাই পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু মাথায় ফ্যান ভেঙে পড়ার জোগাড়। ইয়েতে ভঙ্গ দিতেই হল।

21. দেবারতি ঘুম থেকে উঠে দেখল তার হাতটা উপরে তোলা। তোলা মানে একেবারেই তোলা। গোড়ালি উঁচু করে তাকের উপর থেকে চিনি দেওয়া নারকেলের বিস্কুটের কৌটো পাড়ার মত করে তোলা। বুড়োশিবতলার জোড়া মন্দিরের বড় উঁচু ঘন্টাটা বাজানোর মত করে হাত তোলা। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছক্কাটাকে ক্যাচ করবার জন্য হাত তোলার মত হাত তোলা। এলকেডির ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে রোলকলের সময়ে “প্রেজেন্ট স্যার” বলার মত হাত তোলা। বাসে বগলের ঘামের বৃত্ত দেখিয়ে, সুবাস শুঁকিয়ে ছাদের হ্যান্ডেল ধরবার মত করে হাত তোলা। ডান হাত। তোলা।

আর তোলা তো তোলাই। নামে আর না। বল সকেট গাঁটে আটকে গেছে। দেবারতির কান্না পেয়ে যাবার জোগাড়। এবার কী হবে?

22. একটু আগেই রাম ঝাড় খেয়েছি একটা দশাসই ট্রাফিক সার্জেনের কাছে। ইস্কুল থেকে বেরিয়েছি, কিন্তু বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে খেলা শেষ হয়ে যাবে। মরেই যাবো ততক্ষণে। গোলপার্কের মোড়ে পুলিশটা একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো। খরখর করে আওয়াজ হচ্ছিল রেডিওতে। ভাবলাম কমেন্টারি শুনছে বোধহয়। “কাকু, স্কোরটা কত?” জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ওয়াকি টকি। এবং বেদম ঝাড়।

গড়িয়াহাট অবধি হাঁটলাম। মোড়ের কাছেই একটা টিভি ফ্রিজ এসি ওয়াশিং মেশিন এর শোরুম আছে। ওখানে খেলা দেখাতে পারে। এবং কপাল ভালো। বাদানির ইনসাইড এজ লেগে বেল এর মাথা আর গিলক্রিস্টের হাত টপকে চার। গিলেসপি কাকে একটা খিস্তি করল। আমি টেনশন হলে নখ খাই না। আঙুলের গাঁট কামড়াই। শোরুমের মধ্যে থেকে সঞ্জয়বাবু বললেন বাদানির মধ্যে তিনি ডব্লু জি গ্রেসের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। বারো বলে সতেরো রান বাকি। সমীর দিঘে বেকার রান আউট হয়ে গেল! এমন সময় আমার সহদর্শক একটা উটকো লোক হঠাৎ বলে কী, “এরকম আরেকবার হয়েছিল। ঊনিশশো সাতাত্তর সালে। ওয়ারউইকশায়ার তখন খেলছে গ্ল্যামরগ্যানের বিরুদ্ধে।” আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে।

23. আমার উল্টোদিকের বেঞ্চিতে বসা ভদ্রলোকের দিকে বার বার চোখ চলে চলে যাচ্ছিল। কেন, সে’টা খানিকক্ষণ বাদে বুঝলাম। ফেলুদা হলে এক মিনিটেই ধরে ফেলত, আমি বলেই এত সময় লাগত। ভদ্রলোক খালি সন্তর্পণে এদিক ওদিক চাইছিলেন। কারুর কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয় যেন তার চাউনিতে। তবে সে’টা খটকার কারণ নয়। নজর করছিলেন, আর একটা খাতায় কী যেন লিখে যাচ্ছিলেন। লিখছিলেন, তাঁর ডানদিক থেকে বাঁদিকে। উর্দু লেখার মতো।

24. সেদিন স্টেশনে পৌঁছে শুনি মহা হট্টগোল। কিন্তু ব্যাপার কী, সে’টা ঠাহর হচ্ছে না। ভিড় ঠেলে এগোনোই মুশকিল। এ’দিকে নাছোড় কৌতূহল। একটা লোহার থামের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে একটু লম্বা হয়ে যা দেখলাম, তাতে ঘাম ছুটে গেল। একটা ছেলে। আমারই বয়সী। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে। হাতে একটা কালো ছাতা বাঁইবাঁই করে ঘোরাচ্ছে তলোয়ারের মতো। তার পাঁচ হাত ব্যাসার্ধের মধ্যে কেউ ঘেঁষতে পাচ্ছে না। “খবরদার, খবরদার!” চিৎকার করতে করতে ছেলেটা হঠাৎ আমার চোখে চোখ লাগিয়ে বসল। আমি স্থাণু হয়ে গেলাম। খুব স্পষ্ট আর দৃঢ়তা নিয়ে ছেলেটা বলল, “পৃথিবীর শেষ ঘনিয়ে আসছে। তৈরী হও।”
বাবা বলেছিল, সংবাদপত্র জিনিসটা বাজারে আসার আগে কিছু লোক রাজারাজড়ার পাঠানো ব্রেকিং নিউজ পাড়ায় পাড়ায় চেঁচিয়ে ঘোষণা করে যেত, তাদের বলত খবরদার। এই খবরদারের কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে যাবে, তা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলাম?

25. ঠাণ্ডা যথেষ্ট। কুঁজো হয়ে হাত ঘষতে ঘষতে একটা লোক, বেশি বয়স হবে না, একটা তিলেখচ্চর মার্কা হাসি নিয়ে এসে বলল, “বিড়ি দেখান না একটা।” গালের চামড়া কুঁচকানো, ঠোঁট ফাটা। আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। তর্জনী তুলে দেখালো লোকটা। “হবে? একটা বিড়ি?” আমি মাথা নেড়ে বাস গুমটির দিকে এগোলাম। পিছন থেকে লোকটা ডাকল আবার। “একটা বিড়ি হলে আপনার উপন্যাসটার হিল্লে করে দিতুম মশাই।”
পিছু ফিরতেই হল।

26. বেলা কম হয়নি। খিদে পাচ্ছে। চেম্বারের সবুজ পর্দা অল্প ফাঁক করে বাইরে ওয়েটিং রুমে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কেউ নেই। সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে তার মা এসেছিল। চোখ উল্টে, অ্যা করে জিভ বার করতে বলে, বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে বলে কফ সিরাপ লিখে দিয়েছি। তারা চলে গেছে। এই বেলা খেয়ে আসি।
সাদা অ্যাপ্রনটা চেয়ারে ঝুলিয়ে পার্সটা তুলে বেরোতে যাবো, একটা লোক হুট করে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ল। মাথা গরম হয়ে গেল। খিদে পেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। তবে এ বাবাজির ও মাথা ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই রোদ্দুর গরমে লোকটা একটা মাফলার জড়িয়ে এসেছে। তাও গলায় না, কানের চারপাশ দিয়ে।
ধপ করে বসে পড়লাম আবার। “আমি আগেই আসতাম।” একটু ভাঙা কর্কশ গলায় লোকটা বলল। “আপনার চেম্বার খালি হওয়া অবধি অপেক্ষা করছিলাম।” উদ্ধার করছিলে। আপদ। “কী হয়েছে বলুন?” যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বললাম। শত হোক, আমি ডাক্তার। আমার খিদে পেতে নেই যখন তখন। লোকটা এবার একটু ইতস্তত করে মাথায় জড়ানো ঘি রঙের মাফলারটা খুলে ফেলল। আমার চোয়ালটা খুলে মাটিতে পড়ে গেল বোধহয়।
লোকটার কানদু’টো লম্বায় প্রায় তার মুখ ছুঁই ছুঁই। আর সেগুলো সবুজ।

27. কলিংবেলটা বাজল ভরদুপুরে। বাবা নাক ডাকছে। মা ইস্কুলে। ঘরের মধ্যে এসির চাদর। দরজা খুললেই আটাকামা। কলিংবেলটা আবার বাজল। আরেকবার। চারটে বাছাই খিস্তি দিয়ে মেয়েটা খাট থেকে নামল। আরবীন্দ্রসরোবরএইটবি পায়ের দুমদুমে কাঁপিয়ে গেট অবধি গেল। ঘেমো পোস্টম্যান। “দরজা খুলতে হবে না। সই করে নিন।” একটা ক্লিপবোর্ডের উপর একটা পাতা আর একটা অগ্নি জেল। দ্রুত সই করে দিল মেয়েটা। সাদা খামটা উল্টে দেখল। ভারত সরকারের খাম। ভোটার পরিচয়পত্র। মুহূর্তে একরাশ হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার মুখে। ভোটার কার্ড। তার প্রাপ্তবয়স্কতার স্বীকৃতি। বাসে আর হাফ-টিকিট লাগবে কিনা জানতে চাইবে না কন্ডাকটর।
খামটার মুখ খুলে ছোট্ট আয়তাকার ল্যামিনেট করা পরিচয়পত্রটা বের করে আনল সে। উপরে জ্বলজ্বল করছে তার নাম।
গোবিন্দর মা।
নাহ, একটাও বানান ভুল নেই।

28. ভোররাতে আদিগন্ত ছড়ানো মাঠে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে তাদের বাবা মা’রাও। আরও কিছু গাঁয়ের লোক। আর কিছু সশস্ত্র সৈন্য। তারা একে অপরের মুখোমুখি নয়। সবাই মিলে কিছু ছড়ানো মাটির টুকরোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একটা মূর্তির টুকরো। তার নাসিকাহীন মুণ্ড গড়াগড়ি খাচ্ছে সিকনিঝরা একটা বাচ্চা মেয়ের পায়ের কাছে। ধর থেকে তফাৎ হওয়া ডানহাতটার তর্জনী আকাশের দিকে তাক করা। খানিক দূরে রাজবেশ পরা একটা পেল্লাই লোক মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে। তার মুখে পরাজয়ের গ্লানি। তার সঙ্গীগুলো কে কোথায় পালিয়েছে।
আলো ফুটল। ভিড়ের মধ্যে থেকে তিনটে শরীর এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। একটা বেঁটে লোক। একজন ঢ্যাঙা। আর একটা পুরোহিত। ভিড়ের সামনে, ভাঙা মূর্তির মাঝখানে একটা শান্ত মেয়ে দু’চোখ ভরে ভোর দেখছে তখন।
সেই সকালের প্রথম শব্দ এলো পুরোহিতের মুখ থেকে।
“উদিতা দিদি, যুদ্ধজয়ের বিজয়োৎসব হোক? পাঁজিতে বলছে…”
হাত তুলে তাকে থামালেন উদিতা দিদিমণি।
“এখনও উৎসবের কিছু হয়নি পণ্ডিতমশাই, সবচাইতে কঠিন কাজ এখনও বাকি যে!”
দিদিমণি থামলেন। তারপর চাইলেন বেঁটে আর ঢ্যাঙার দিকে।
“গুপী, বাঘা, তোমরা আজ একটা গান শোনাবে না?”

29. ভদ্রলোক ছবিটা শেষ করে তুলি নামিয়ে রেখে কাঠের টুলে বসে অপলক তাকিয়ে রইলেন ক্যানভাসের দিকে। শেষ করার পর নিজের আঁকা আর নিজের বলে মনে হয়না। গত গোটা রাতটার মানুষ, আর এই চেয়ে থাকা মানুষটা এক নয়। ওই মানুষটা অন্য কেউ। হয়ত আর অস্তিত্বই নেই তাঁর। লোকটা গ্যালারিতে বসে অন্যের ছবি দেখবার মতো দেখে যেতে লাগলেন। এই মানুষটা দর্শক। শিল্পী নন।
ক্যানভাসে তখন একটা হাল্কা ফোকাস নড়ে যাওয়া আলোকচিত্রর মত পট। শেষ বিকেল। ক্যানভাসের দুই তৃতীয়াংশ শুধু আকাশ। মেঘের মধ্যে একখানা ফুটো দিয়ে ঘোলাটে রোদ। ঝড় আসব আসব। মেঘগুলো স্থির। তলার দিকে একটা মাঠ। মাঠের বুক চিরে একটা রাস্তা। কালো পিচের। খানাখন্দ। সেই রাস্তার দু’পাশে আগাছা। ডানদিকে একটা ভাঙা গাড়ি পড়ে আছে। গাড়ি তো নয়। একটা মরচে ধরা এরোপ্লেন না? ভোঁতা নাক। একটা ডানা। তার পাশ থেকে একটা অস্পষ্ট যন্ত্র ঋজু উঠে গেছে আকাশে। স্থির। রাডারের মতো। একেবারে দিগন্তের কাছাকাছি বড়সড় বাড়ি একটা। শ্যাওলা। নোনা। স্পষ্টতই, এই বন্দর পরিত্যক্ত।
হাত থেকে রঙ মুছে ফেলতে পারলেন না ভদ্রলোক। শেষ হয়নি। কিছু একটা নেই। ফাঁকা লাগছে। অসমাপ্ত। দর্শক হুট করে আঁকিয়ে হয়ে গেলেন আবার। রাস্তার পাশে তুলি বোলাতে লাগলেন। একটা অবয়ব ফুটে উঠতে লাগল। দু’টো পা। হাঁটু ভাঁজ করা। তার উপর আড়াআড়ি দু’টো হাত। তার উপর একটা মাথা। মাথা, কাঁধ জুড়ে এলোমেলো চুল। মুখ গোঁজা সাদার উপর লাল ফুল ফুল ফ্রকে। এই ফ্যাকাশে বর্ণহীন ছবিতে একমাত্র রঙ। এমন ছবিতে কিশোরী মানায় ভালো।
ভদ্রলোক পিছিয়ে এসে দাঁড়ালেন। এবার হয়েছে।

30. এক চুলও নড়ছে না। দাঁড়িয়ে আছে মহাস্থবিরের মত। গোটা হাইওয়ে জুড়ে যত দূর চোখ যায় গাড়ির সারি। তাদের চাকা কোন অভিশাপে মাটি ছুঁয়েই আছে। কিন্তু কারুর তাতে মাথাব্যথা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। সকলেরই চোখ আকাশে। সে’খানে একটা বিন্দু ক্রমশ বড় হচ্ছে। চোখের সামনে। উজ্জ্বলতর হচ্ছে। উষ্ণতর হচ্ছে। একটা টেকো বুড়ো একটা ফোর্ডের পিক আপ ট্রাক থেকে বেরিয়ে আবোল তাবোল বকছে। ভিড়ের গুঞ্জন ছাপিয়ে তার এক দু’টো কথা কানে আসছে। কেয়ামৎ। চরম বিচার। জাজমেন্ট ডে। কী’সব!

“খুব ভুল কিছু বলছে না।” চমকে পিছন ফিরে তাকালাম। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। এঁকে দেখে কিন্তু ক্ষ্যাপা বলে মনে হয় না। উলটে সম্ভ্রম জাগে।

“ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকে এ’রকম হয়েছিল একবার। অতিকায় কিছু প্রাণী স্রেফ অ্যানাইহিলেটেড হয়ে গেছিল। নিশ্চিহ্ন। কর্পূর।” আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, “ওটা মিটিওর?” ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। “না। উল্কা নয়। মহাজাগতিক পাষাণ যখন আমাদের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পুড়ে যায়, তাকে বলে উল্কা। মিটিওর। এ’টা তার চেয়ে ঢের ভয়ঙ্কর। এ’টা একটা কক্ষচ্যুত গ্রহাণু। অ্যাস্টেরয়ড।” আমার কপালে ঘাম ছিলোই, কারণ গরম বাড়ছে, এবার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। “তবে? এবার কী হবে?” ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম। উনি মৃদু হেসে বললেন, “দেখাই যাক না, আমার হলুদের জোর কতদূর?” হলুদ? মাথামুণ্ড কিছুই বুঝলাম না। তবে ভদ্রলোককে হাতছাড়া করা যাবে না। উনি নিজের গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন দেখে হাঁক পাড়লাম, “ও মশাই?”

জানালা থেকে মাথা বের করে উত্তর দিলেন তিনি। “বৈদ্য। ডঃ বৈদ্য। ভিড়ে পড়বেন নাকি আমার সাথে?”

31. আলো কমে আসছে। আরও একবার কড়া নাড়লাম দরজার। ভিতর থেকে বন্ধ যখন, ঘর খালি নয়। হাল ছাড়া যাবে না। এই বিতিকিচ্ছিরি রাতটা একটা আগাছাময় স্টিমারঘাটে কাটানো যুক্তিযুক্ত নয়। বৃষ্টির আগের ভ্যাপসা ছেড়েছে। খট খট খট। কিছু দোকানপাট আছে অঞ্চলে। ঝাঁপ বন্ধ। এক এটাই ভিতর থেকে আগল দেওয়া। খট খট। কে রে ভাই? কালা, নাকি? আকাশের অবস্থা জরিপ করছিলাম, এমন সময় দরজা খুলে গেল। একটা আধো অন্ধকার খুপচি দোকান। দোকান? ভিতরে পসরা কিছু তো নেই? “আসলে আমি কানে ভালো শুনিনা।” জানতাম। প্যাংলা বুড়ো একটা। মাথায় ফেজ। সাদা গেঞ্জি। নীল লুঙ্গি। “বসুন। বসুন। দরজাটা খোলাই থাক আপাতত। একটু হাওয়া আসুক।” বয়স কম হয়নি লোকটার। লোলচর্ম। কিন্তু দৃঢ়। ঋজু। কোমর সোজা। একটু শ্লথ, বয়সের ভারে।

“আপনি এখানেই থাকেন?” শুধোলুম।
“থাকি কি আর? পড়ে থাকি।”
“বউ বাচ্চা?”
লোকটা হাসল শুনে। কোনও উত্তর দিল না।
“আপনার চলে কী করে?”
“কী জানি। চলে যায়। যতক্ষণ চলছে, ভাবিনা।”

আমার হঠাৎ খুব হিংসে হল লোকটার উপর। কীসের জন্য এত ঘানি টানছি কে জানে। মেঘটা ঝুঁকে এসেছে নদীর উপর। কালিন্দী। গুড়গুড় করছে। বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। ছোটবেলায় বাবার কাছে শেখা একটা সুর কোত্থেকে গজিয়ে উঠল। সুসময়ে দিন গুয়াইয়া, ও মন, অসময়ে আইলাম নদীর পাড়ে। মাঝি তোর নাম জানিনা। এই রে। লোকটার নাম জানা হয়নি। একচালা ঘরের ভিতরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি বুড়ো হাওয়া। বস্তাপচা বাংলা ভূতের গল্পের সেটিং। তবু শালা ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। “শুনছেন?” উদ্দেশ্যহীন ভাবে ডাকটা ভাসিয়ে দিলাম। যেখানে যাবে যাক। ঘরের কোণের অন্ধকার থেকে উত্তর এলো। “থামলেন কেন, ভাটিয়ালি আজকাল আর কেউ গায় না, গান না!” নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছে হল। চোখ সয়ে এসেছে। বুড়ো একটা কাঠের বাক্স থেকে কী’সব বের করছে। একটা তক্তা মত। একদিক চকচক করছে এই অন্ধকারেও। তক্তার তলায় গোল মত কী যেন।

বুড়ো আলোয় সরে এলো। বাবু হয়ে বসে যন্ত্রটা কোলে রাখল। একটা সরোদ! কান মুলতে লাগল আদর করে। “একটু বাজাই। শুনবেন?” আমি বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়লাম। মসৃণ ইস্পাতে ক’টা তারের উপর বুড়োর ক্ষীণ আঙুলগুলো অবাধ বিচরণ করতে লাগল। সুরটা একটা চেনা গানের কাছাকাছি। কথাগুলো মনে পড়ছে না। মাঝখানটা আবছা। অতহী ডরায়ে কারি কারি আঁখিয়া…

বাইরে ঝুপুস করে বৃষ্টি নামল।

32. ঢেঁকুরটা উঠল একেবারে তলপেট থেকে। তার ফলে নাক থেকে যে পরিমাণ হাওয়া একসাথে বেরোল, তার ধাক্কায় ভনভনময় মাছিগুলো সাত হাত দূরে ছিটকে পড়ল। এই আচমকা পপাতে মাছিগুলোর মাথাটাথা ঘুরে গেছিল বোধহয়, তাই আর বাঘটার মুখের চারপাশে ঘেঁষল না। পিছন দিকে এখনও বেশ কিছু আছে, কিন্তু ল্যাজ নাড়াতে বাঘটার বড় আলিস্যি। জবর খ্যাঁটন হয়েছে। মুখ ধোয়া হয়নি। কবেই বা হয়? থাবায় এখনও খাসীর গন্ধ। বাঘটা একটা পেল্লাই হাই তুলল। সামনে কেউ থাকলে তার ডাম্বেলের মত আলজিভ আর পেয়ারার মত টনসিল দেখতে পেত। গত শীতে মোক্ষম ঠাণ্ডা লেগেছিল যখন, পেয়ারাগুলো বাতাবি হয়ে গেছিল। নাক থেকে লিচুর সরবতের মত সর্দি বেরোত। যাক গে। থাবার উপর মাথা রেখে চোখটা বন্ধ করবে, এমন সময় বাঘটা মেয়েটাকে দেখতে পেলো।

শিরদাঁড়া দিয়ে ডিপফ্রিজের জল বয়ে গেল। দেখে ফেলেছে। এখন পালাবার উপায় নেই। পা অচল। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। দশ ফুট। ছয় ফুট। চার ফুট।

“আমার তুই লেপের উপর শুয়েছিস? হত্তভাগা! কতবার বলেছি তোর গায়ে মোষপচা গন্ধ? আবার লেপটা কাচতে হবে আমায়। সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!” বলতে বলতে একটা হাওয়াই চপ্পল এসে পড়ল বাঘটার গায়। ঘ্যাঁও করে একটা আর্তনাদ ছেড়ে সে ছাদের উপর শুকোতে দেওয়া লেপ থেকে তড়াক করে উঠে জলের ট্যাঙ্কির তলায় গিয়ে সেঁধোল। বাইরে মেয়েটা তখনও তড়পাচ্ছে। “বেরো বলছি কিন্তু…”

33. পানটা সাজতে প্রসাদ সময় নিলো পাক্কা ছ’মিনিট। সঙ্গে হাজারটা আনতাবড়ি কথা। মোগলসরাইএর নাম বদলে দিয়েছে। কী দরকার ছিল। সে ছোট থেকে সেখানে মানুষ। সেও তো হিন্দু। কই নামে মোগল আছে বলে তো ঘর বলে ভাবতে অসুবিধে হয়নি কোনওদিন। ইত্যাদি। এই গোটা ছ মিনিট সুকুমারবাবু ফুটপাতের উপর ল্যাম্পপোস্ট ঘেঁষে দাঁড়ানো বাচ্চা মেয়েটাকে নজর করে গেছেন। চোদ্দ পনেরো হবে। কমই হয়ত। তার ছেলেরই বয়সী। তার ছেলেরই ইস্কুলের ইউনিফর্ম পরা। সাদা ব্লাউজ। বুকে হিজিবিজি নকশায় তার ছেলেরই স্কুলের নাম লেখা। নীল স্কার্ট। বিনুনি। মুখ চুন। মিষ্টি মেয়ে। পান হাতে পেয়ে মুখে পুরতে পুরতে মেয়েটার গালে জল এসে পড়েছে। সুকুমারবাবু বিচলিত হলেন। কাঁদে কেন মেয়েটা? জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা ভাবলেন। তারপর ভাবলেন তার নিজের মিয়োনো মোয়ার মত ছেলেটা যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদত, তবে কি কেউ এসে শুধোত না, কী হয়েছে?

সুকুমারবাবু একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেলেন।
“কী হয়েছে?”
মেয়েটা মুখ তুলে তাকালো। তারপর হড়বড় করে বলতে লাগল।
“ব্যাগটা রয়ে গেছে স্কুলবাসে। বিদিশার সাথে গল্প করতে করতে নেমে গেছি, মনেই নেই, সিটের উপর… সেলেনার ছবি দেওয়া। নতুউউন ব্যাগ। বাবা শনিবারই এনে দিয়েছে। সামনের চেনে একটা মিনিয়ন লাগিয়েছিলাম।”

সুকুমারবাবু একটু থমকালেন। গোদোও একটা নটরাজের কমলা রঙের নতুন কেনা জ্যামিতি বাক্স হারিয়ে এসেছে গত হপ্তায়। তিনি গোদোকে অল্পসল্প পেঁদিয়েছেন। কাজটা ঠিক করেন নি।
“বাবা মা বকবে?”
মেয়েটা অল্প মাথা নাড়ল উপর নিচ। তারপর খুব আস্তে প্রায় না শোনানোর মতন করে বলল, “সাত্যকির চিঠিটা ব্যাগে রয়ে গেছে। পড়াই হয়নি।”

সুকুমারবাবু থ হয়ে গেলেন। গোদোর কপালে আজ আরও দুঃখ আছে।

34. ললাটে বন্দুক ঠেকানো থাকলে যে কারুর লাট খেয়ে যাবার কথা। আমিও খেলাম। হাত দু’টো সোজা আকাশে তাক করা। চোখ টেরিয়ে বন্দুকের নল দেখবার চেষ্টা করছে।
“আমার দিকে তাকান।” শারুক্ষানের সিনেমার দিকে তাকাতে বললেও তাকাতাম। প্রাণ আগে ভাই। আমি খুব ভীতু। এত এত পাপ করেছি ইহজন্মে, যে একবার পাঁচিল টপকালে যমবাবু নিজের হাতে আমায় ভালোবাসবেন। তাকালাম। একটা হেব্বি ঢ্যাঙা মেয়ে। ডানহাতের তর্জনী ট্রিগারের উপর কাঁপছে। এই দিলো টেনে। বাবা রে। আমি হাউমাউ করে “আমাকে মারবেন না স্যার। হুজুর আপনি আমার মা বাপ। সারাজীবন আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব হুজুর। কাল থেকে ঠিক সৎ পথে চলব দেখবেন। হোমওয়র্ক করব। লেডিজদের মাল বলব না। মাইরি” বলে কান ধরলাম। তারপর ভাবলাম হাত তুলতে বলেছিল, নামিয়ে কানে দিলে যদি ঘোড়া টিপে দেয়? ওমনি দুম করে হাত উপরে। মেয়েটা একটুও গলল না। নলটা ঠেসে ধরল কপালে। আমি ভয়ে চোখ বুঁজে ফেললাম। হুঙ্কার এলো। “চোখ খোলা!” চোখের আর সাধ্যি কী যে বন্ধ থাকে। মহিলা চায় কী? “ওয়ালেট ডানদিকের পকেটে স্যার। ইয়ে ম্যাডাম। পিছনে রাখিনা। কোমরে ব্যথা হয়। বের করে দিই?” মেয়েটার ভুরু দু’টো কুঁচকালো। উফ। আমার ছোট বাথরুম পেয়ে গেছে। বন্দুক নড়ছে না। “বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে জাঁহাপনা। না খেতে পেয়ে মরবে।” মহিলা এবার খুব খচে গিয়ে বললেন, “আর একটাও মিথ্যে কথা বলবি তো ঘিলু বের করে দেবো। বউ? বাচ্চা? ন্যাকা! আমি কি গাধা? কবে থেকে স্টক করছি!”

35. ঘোড়াটা পুঁইশাক খাচ্ছিল। আমি হাঁ করে দেখছিলাম। ডাঁটা শুদ্ধু। একটা মানিকতলা হাওড়া মিনিতে জানলার ধারে বসে একটা ঘোড়া পুঁইশাক খাচ্ছিল। কন্ডাকটর এসে ঝনার্ঝন করে থলে নাচিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে ধরা টিকিটে খচরমচর বাজনা বাজিয়ে টিকিট চাইল। উত্তরে ঘোড়াটা চিঁ চিঁ করে কী বলল ভালো শুনতে পেলাম না। চিংড়িহাটা তো এ বাস যায় না। যাই হোক, কন্ডাকটর ভদ্রলোক বোধহয় শুনতে পেয়েছিল, এক আঁটি পুঁইশাক ঘোড়াটার থেকে নিয়ে চামড়ার থলেতে পুরল, আর একটা সাত টাকার টিকিট দিলো।
এর মধ্যে আরেক বিপদ। একজন মোটাসোটা মহিলা শেয়ালদায় নামার সময় আমাকে “জীবনে যেন ঘোড়া দেখেনি! বাড়িতে আস্তাবল নেই?” বলে পাঁচ কথা শুনিয়ে গেল। আশ্চর্য! ঘোড়া আমি দেখেছি বিস্তর। তারা মিনিবাসে আকছার চড়ে। কিন্তু সে’সব ঘোড়াদের নাকে এত বড় শিং আমি দেখিনি কোত্থাও। যাকগে, পাছে বেশি তাকালে লোকে ইতর ভাবে, তাই অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।

36. I wanted to laugh. I almost did, but checked myself. I wouldn’t dare laugh at a lady with pigeon droppings on her hair. She looked at the heavens, but the culprit had fled the scene. “No pigeons in California?” I asked. “Southern”, she corrected me. “Southern California. There are, but they don’t drop shells on people.” I had to sympathize. After all, she was a guest in my city. After a tedious session of wiping out every last bit of bird poop from the face of her hair, she marched forward. I followed, as I had been, as any good sidekick would. I didn’t want to miss out on chronicling an incredible adventure of the mighty explorer. A journey across the tumultuous ocean, the placid desert, the lonely mountains and the crowded cities, to seek a treasure that is matched by none other. Did you really think the conspiracy of a few pigeons can deter her?

37. “তারপর?”
“তারপর টেক্সাস যাবো ভাই। চামড়ার বুট। গোড়ালির কাছে কাঁটা দেওয়া চাকা। কোমরে চামড়ার বেল্ট। সেখান থেকে একটা ম্যাগনাম রিভলভার ঝুলছে। মাথায় রাখালদের টুপি, বুঝলি। আর পকেটে একটা অম্রুতাঞ্জনের কৌটো। ডন অনি। ইস্টউড ফেল মেরে যাবে ভাই। ছোট্ট গেলাস থেকে সুরুৎ করে নিট হুইস্কি খাবো। নিট। হুঁ হুঁ বাবা। বহিরাগত ভেবে লোকাল মাতালরা তাকিয়ে থাকবে। সরু কোমর বারটেন্ডার মেয়েটা শুধোবে, হোয়ার আর ইউ ফ্রম, হ্যান্ডসাম? আমি খড়কেকাঠি চিবুতে চিবুতে বলব, পথ ই আমার বাড়ি। কাঠের টেবিলে একটা ডলারের নোট ঘষটে দিয়ে বলব, কিপ দ্য চেঞ্জ। তারপর…”
“তারপর?”
“তারপর মাসির দোকানে গিয়ে একটা লঙ্কাগুঁড়ো দেওয়া ডিমসেদ্ধ আর একটা সিগারেট খাবো।”

38. “তোকে ওই গল্পটা বলেছি?”

আমার দুই দিকে দুই মূর্তি। তারা একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। পিড়িং পিড়িং করে খোঁচা আসছে। আমি যেন নেটের কাছে বসে টেনিস দেখছি। ডান দিক বাঁ দিক ডান বাঁ ডান …

“তোকে ওই গল্পটা বলেছি?”
“একবার কী হয়েছিল জানিস?”
“সায়ক হেব্বি ভূতে ভয় পায়।”
“কণাদ যা দাঁত কেলায়!”
“তারপর তো কৌশিকদার বাড়িতে ভূতের সিনেমা চালিয়েছি।”
“কণাদের হাতে তো স্টিয়ারিং।”
“সায়ক দেখবে না বলে ঘুমিয়ে গেছে।”
“আমি তো সামনের সীটে ঘুমিয়ে গেছি।”
“সিনেমা শেষ, রাত হয়েছে, আমি বাড়ি চলে গেছি।”
“ঘুম ভেঙে দেখি গাড়ি হাইওয়েতে বাঁই বাঁই ঘুরছে।”
“ঘুম ভেঙে দেখে কেউ নেই বাড়িতে।”
“আর আমার তো খুব ভয় লাগছে।”
“আর ওর তো সেই ভয় লাগছে।”
“তারপর হল কী!”
“তারপর হল কী!”

তারপর আমার জানালার বাইরে দেখি জল জমে গেছে। ঘরটা আস্তে আস্তে জলের তলায় ডুবে গেল। দেওয়ালগুলো কেমন হলুদ হলুদ লাগছে। জানলা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, দেখি একটা বয়স্ক সিন্ধুঘোটক আমারই দরজার দিকে এগিয়ে আসছে জলের তলা দিয়ে, ছাতা মাথায়। কলিং বেল টিপল। আমি দরজা খুললাম। সিন্ধুঘোটকটা ইয়াব্বড় দু’টো দাঁত বের করে বলল আল আমীন থেকে বিরিয়ানি এনেছি। তোর কাছে আই পি এ আছে?

39. গল্প হচ্ছে আমাদের ক্লাস নাইনের টিচার ইন-চার্জ আমার প্রেমিকা ছিলেন। আমাদের। তবে জানতেন বলে মনে হয় না। উনি ট্যাক্সি করে ইস্কুল আসতেন। ওনার বাড়ি থেকে ইস্কুল আসতে যত মিটার উঠত, তার থেকে বেশি উঠত স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে, ওনার নামার অপেক্ষায়। উনি যে দিকের দরজা দিয়ে নামতেন, ট্যাক্সিটা সেই দিকের চাকার উপর হেলে যেত। আমরা হাঁ করে দেখতাম। তারপর উনি লিফটে উঠে চার তলার বোতাম টিপলে সে’টা এক তলায় উঠত।

একবার খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মাথায় লেগে একটা ফুলের টব ভেঙে ফেলেছি। নিয়ে গেছে দারোয়ান ওঁর কাছে। আমি চুপ। Swarnabha বলছে “আম্মিকিছুকরিনিসবওকরেছেয়ামায়ছেড়েদিন্মাইরিবলছিয়াপনারট্যাক্সিরদিব্যি”
উনি ওকে চুপ করিয়ে আমায় কাছে ডেকে নিলেন। আমার তো পা সরে না। আমায় বললেন “আহ। কোথায় লেগেছে দেখি? রক্ত বেরোচ্ছে? ফার্স্ট এইড?” আমি চুপ। “কী যে করো না তোমরা, টব না হয় কেনা যাবে আরেকটা। মাথাটা ভাঙলে কী হত বলো তো?”

একবার হয়েছে কী, আমাদের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ক্লাস হচ্ছে।
স্যার আসেনি, হেব্বি চিল্লামেল্লি। মহিলা নেমে এসেছেন। এসে আমাদের সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের তো ক্রাশ। আমরা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে, আর অরুময় আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করে যাচ্ছে
গুমসুম হো কিঁউ, পাস আও না।
রুঠে হো ইউ, মুসকুরাও না।
আমি ফিক করে হেসে ফেলেছি। আর উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন, “তুমি আমাকে দেখলেই হাসো কেন বলো তো?”
আমার তো মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে বলি, “একটা পান দাও না ঠাম্মি, খয়ের দিয়ে দেবে।”

40. মনে খুব শান্তি ছিল। খুব। আর কোনও ঝঞ্ঝাট নেই। কিছুর পরোয়া নেই। আর বড়জোর মিনিট পাঁচেক, তারপর মুক্তি। নিশ্চিন্তি। আহা। ব্যথা নেই, বেদনা নেই। হাহুতাশ নেই। হাগু পেয়েছে বলে ঘামতে ঘামতে এগারো টাকা রিস্কাভাড়া দিয়ে বাড়ি ফেরা নেই। সকাল বিকেল পরোটা ঘুগনি দেখলেই নোলা সপসপ করা নেই। সময়ে অসময়ে ছোটবাবুর খিদে পাওয়া নেই। বড় শান্তি। মিনিবাসটা বড় মোক্ষম জায়গায় মেরেছে। হাড্ডি ভাঙার চোটও অবশ হয়ে গেছে। এদিক ওদিক একটু লাল ছোপ। ও থাক। আরামে চোখ বুঁজেছিলাম। ওমা। চোখ খুলে দেখি মরিনি। পাঁজরায় বেদম যন্তরনা। হাত পা সাদা সেলুটেপ না কীসে মোড়া। মরণ হয়নি, মরণদশা! তারউপর এক কোট পরা ম্যাডাম এসে চোখে আলো ফেলছে। ও শাঁকচুন্নি, বলি মরতে দিবি আমায় না কী রে? ও ডাক্তারের ঝি, বলি মরণ যে এসে গেচিল এ পাড়ায়। তাকে দেকতে পেলুম ওই দাঁড়িয়ে রয়েচে ওইখানে। তুই আমায় যেতে দিলিনে রে? মুখপুড়ি! যা না ওই ওদের গিয়ে বাঁচা যা, আমার থেকে কিছু পাবিনে। একটা কড়ি না। এদিকে মুখ চলে না। চোয়াল নড়ে না। সে ইয়ের বেটি এসে সুঁই ফুটিয়ে দিল একটা তারপর। মার না, মার? মেরেই ফেল। মরেই তো যাচ্ছিলাম। ফিরিয়ে আনলি কেন রে হতভাগী? নিজে হাতে মারবি বলে? আবার কতা কয় দেকো? খুব মুখ মিষ্টি না তোর? এত সেবা করছিস, আমি কে তোর?

41. অসূর্যম্পশ্যা গুহা। তাও চোখ সয়ে গেল ঠিক। চোখ সইল, মন সইল না। কীভাবে এলাম এখানে, মনে পড়ছে না। অন্ধকারে যাবতীয় স্মৃতি হারিয়ে গেছে। খুঁজে লাভ নেই। আমার গোঙানি পাথুরে দেওয়ালে ঠোকর খেয়ে ফিরছে। আর একটা শব্দ। পাথরে ধাতু আছড়ানোর শব্দ। ক্রমাগত। কিন্তু তালে নয়। লয় কমছে বাড়ছে। জোরও। পাথর ভাঙার যান্ত্রিক স্থূল শব্দ নয়। ভাঙার শব্দ নয়। গড়ার শব্দ।

স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল মেঝে। কোথাও জলের ধারা আছে বোধহয়। বড় অসহায় লাগে, দৃষ্টি ছাড়া, স্মৃতি ছাড়া। উঠে দাঁড়ালাম। প্রশস্ত গুহা। হাওয়া বাতাস আছে, তাই দম বন্ধ লাগছে না। উঠে এলোমেলো দু’পা ঘুরতেই একদিকে একটা ক্ষীণ আলোর আভাস পেলাম মনে হল। ওতেই হবে। সাবধানে পা বাঁচিয়ে এগোলাম। সেই মুখে পৌঁছে ভয়ে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। একটা লোমশ জন্তু। দুই পেয়ে। ভালুকের মত। না। না! এ তো মানুষ! এর কোমরে একটা বাকল! ভাঁটার মত উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। তার হাতে একটা ধাতুর টুকরো। অন্যহাতে একটা পাথর।অস্ত্র? কিন্তু মানুষটার চোখে কী? ভয়ই তো?

মুহূর্তে হাতের অস্ত্র ফেলে মানুষটা দৌড় দিল উলটো দিকে। আদিম দৌড়। আমি গুহার মুখে এগিয়ে গেলাম। পায়ের কাছে পাথরের টুকরো। পাথরের গুঁড়ো। বাইরে পায়ের তলায় অনেক নীচে জঙ্গল। ঘন। দুর্ভেদ্য। সেই জঙ্গলের ধার বেয়ে সূর্য্য ডুবছে। সেই পড়ন্ত সূর্য্যের আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের উপর এই গুহার দেওয়ালে।

সেখানে পাথরে খোদাই করে একটা কিছু আঁকা। একটা বাইসন!