অনেকক্ষণ ধরেই সামনে একটা গাড়ি ঢিমে চালে চলছে। চাইলেই সুমন তাকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারত, কিন্তু যাচ্ছে না। যাচ্ছে না, কারণ নেশা লেগে গেছে। ঠিক নেশা না, নেশার মতন। একটা আচ্ছন্ন ভাব। নিজেকে যেন আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে তার কাছে। সে গাড়ি যেন তার পথপ্রদর্শক। সুমন যেন আর নিজের ইচ্ছেয় চালাচ্ছে না গাড়ি। নিকষ রাতে সামনের গাড়িটার টেললাইট এর লাল চোখ দুটো তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে। তাই জিপিএসের ব্রিটিশ মহিলা তাকে মানা করা সত্ত্বেও সুমন হাইওয়ে থেকে ডান দিকে মোড় নিল। লাল চোখের পিছন পিছন। আর ডানদিকে ঘুরেই একথালা চাঁদ চোখে পড়ল তার। এতক্ষণ ডানদিকের পাইন গাছের সারিতে সে ভদ্রলোক ঢাকা পড়ে ছিলেন। সে পাইনগুলোর রীতিমতো ছায়া পড়ছিল কালো রাস্তায়। মনে হচ্ছিল ভোর হয়ে আসছে বুঝি। কিন্তু রাত কাবার হতে বাস্তবিক ই অনেক দেরী। লাল চোখের টানে সরু অথচ বলিষ্ঠ রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে চলল সুমন।

কলকাতা থেকে শেষ রাতের ট্রেন ধরেছিল লোকটা। যেমন হয়। শ্বশুরবাড়িই যাচ্ছিল বোধহয়। ফাঁকা ট্রেন। যেমন হয়। আধা আঁধারি স্টেশন। একটা সন্দেহজনক স্টেশনমাস্টার। “এখন তো আর গাড়ি নেই। স্টেশনেই থেকে যান, নয়ত হেঁটে ক্রোশ চারেক।” লোকটা হাঁটা শুরু করেছিল, নইলে বউ এর হাত থেকে রক্ষে নেই। যেমন হয়। তারপর ধুধু মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা বাড়ি। অল্প আলো। যেমন হয়।

সেই বাড়িটা দেখতে পেল সুমন। রাস্তার বাঁ ধারে। একটা আদিগন্ত মাঠের মধ্যে একটা একলা বাড়ি। রাস্তা থেকে অনেকখানিই হেঁটে। বেড়া দেওয়া। সে বাড়ির ঠিক উপরে একথালা চাঁদ। এত বড় চাঁদ বহুদিন দেখেনি সুমন। বেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সামনে তাকিয়ে দেখল লাল চোখ গাড়িটা আর নেই। বাড়িটা দেখার চক্করে গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিল সে। সামনের গাড়িটা এগিয়ে গেছে। হুট করে ঘোর কেটে গেল সুমনের। এ’টা কোথায়? না। মানে এ’টা কোথায়? সিরিয়াসলি, সুমন এ’টা কোথায়? নিজেকে নিঃশব্দে ধমকায় সে। ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? কী ভাবছিলটা কী সে? সে ভাবছিল না। এখনও ভাবছে না খুব একটা। অতিকায় মাঠটার মধ্যে বেমানান বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ফের স্থানকাল বিস্মৃত হল সুমন।

“এই বাড়িটায় যদি আমি থাকতাম, আর রাতের বেলা যদি জ্যোৎস্না দেখতে বেরোতাম, তা’হলে তো ভয়ের চোটে নিজের বাড়িতেই ঢুকতে পারতাম না!” বাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে মাঠটাকে আড়াআড়ি চিরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল লোকটা। রাম্রাম্রাম্রাম। তারপর যথারীতি জঙ্গল। যেমন হয়। ঝিঁঝিঁ। শেয়ালের ডাক। কারুর দু’টো জ্বলজ্বলে চোখে। কাঁটাঝোপে ছড়ে যাওয়া পা। তারপর একটা রাস্তা। শেষমেশ। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটা লাগিয়েছিল লোকটা। তখনই গাড়িটাকে দেখতে পায়। তার পিছন দিক থেকে মন্থর গতিতে আসছে।

সুমনের দ্বিতীয় ঘোর সুমনকে বাড়িটার দিকে টেনে নিয়ে যায়নি। যেমন করে এসেছিল, সে’রকম ঝুপ করে নিভে গেল নেশাটা। দু’টো জিনিস টের পেল সুমন। এক, হয় সে বদ্ধ কালা হয়ে গেছে, নয়ত পৃথিবীতে আর এক ফোঁটা শব্দও নেই। একটুও না। ঝিঁঝিঁ টুকুও না। হাত বাড়িয়ে গাড়ির হর্ন অবধি পৌঁছেও হাত সরিয়ে নিল সে। আওয়াজ করার ক্ষমতা আর তার নেই। নো ওয়ন ডেয়ার্স টু ডিস্টার্ব দ্য সাউন্ড অফ সাইলেন্স। আহ, অন্ধকার, আমার প্রাচীনতম বন্ধু। দুই, একথালা চাঁদে দৃশ্যমান ওই বাড়িটুকু আর তার কালো গাড়িটা ছাড়া আর কোত্থাও কিছু নেই। পদার্থবিজ্ঞান বলে মানুষ আলো দেখতে পায় না, আলো কিছুর উপর পড়ে প্রতিফলিত হলে সেই বস্তুটিই কেবল দেখা যায়। অর্থাৎ প্রতিফলিত হবার মত কিছু না থাকলে অগাধ ফুটফুটে আলো থাকলেও আমরা চোখে অন্ধকারই দেখব। মহাকাশে সে’টাই হয়। এই গ্রহের চাদরের বাইরে বেরোলে নিদেনপক্ষে বায়ুটুকুও থাকেনা আলো ঠিকরানোর জন্য। বাইরে আকাশ তাই কালো। চাদর নীল। আচ্ছা, সুমন ভাবল, বায়ু ছাড়া শব্দও তো এগোবে না। তাই ই কি… নাহ, তবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কী করে? হাতটা মুখের কাছে এনে হাহ করে শ্বাস ছাড়ল সুমন। হাতে কিছু টের পেল না।

গাড়িটা দেখে প্রাণে ধর পেল লোকটা। বা ধরে প্রাণ। প্রাণধর ই ছিল না? লোকটার নাম? হাত দেখিয়ে লম্ফঝম্প করে থামানোর চেষ্টা করেছিল। থামার লক্ষণ দেখায়নি। তাই রাম্রাম বলে ধীরবাহনের দরজা হ্যাঁচকা খুলে সে উঠে পড়েছিল। উঠে পড়ে দেখেছিল তাতে চালক নেই। যেমন হয়। আত্মারাম খাঁচার দরজা খোলা পেয়ে ছাড়ব ছাড়ব করছে, তখন গাড়িটা থেমে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে প্রাণধর দেখেছিল একটা লোক হাঁফাতে হাঁফাতে ঘাম মুছছে গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে। প্রাণধরকে বলেছিল সে, “পিছনটা বেঁকে গেল মশাই গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে। চড়ে না বসে হাত লাগান না?!”

ছোট্টবেলায় এই গল্পটা সুমনকে বাবা শুনিয়েছিল। কায়দা করে, গলা খাদে নামিয়ে। শিব্রাম বা ও’রম কারুর লেখা বোধহয়। সুমন দিব্যি ভয়টা উপভোগ করছিল শুরুতে। দিব্যি। ছোট্ট চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেছিল। বাবা গল্প বলত ভালো। তারপর শেষটা শুনে হোহো করে হেসেছিল। কী বোকা প্রাণধর লোকটা, এতে কেউ ভয় পায়? রাগও হয়েছিল নিজের উপর। কী বোকা সে, এতে কেউ ভয় পায়? কিন্তু এখন এই যে তার নিঃশ্বাস পড়ছে না, এতেও কি ভয় পাওয়া উচিৎ নয়? সে পাচ্ছে না কেন? এই বাড়িটাকে এত আপন লাগছে কেন? বাড়িটার ডাইনে বাঁয়ে পিছনে আর কী আছে? শুধু মাঠ? সুমন ঘাসে ঘাসে পা ফেলে এগোতে লাগল। বাড়িটা বড় হচ্ছে একটু একটু করে। মাঠটা তো আর বাড়ছে না? বাড়ির পিছনে কালো আকাশ। কয়েকটা তারা উপরে। নীচেও। সুমন বড়িটার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার আর তার কালো গাড়িটার মাঝখানে নিঝুম বাড়িটা। আর তার সামনে… মাঠটা শেষ হয়ে গেছে। আর এক পা বাড়ালে সে খাদে পড়ে যাবে। সামনে অনেকটা আকাশ। উপরে, নীচে। সেই অসীম মিশকালো আকাশে সুমন একথালা চাঁদের তলায় একফালি পৃথিবী দেখতে পেল।