কিম্ভূতদর্শন ছায়াগুলো ঝুঁকে পড়ে খুব গম্ভীর, ফিসফিসে অথচ দৃঢ় গলায় বলছিল, “ওঠো। উঠে পড়ো”। তাদের গলায় একটা জাজমেন্ট ডে মার্কা কাঠিন্য। “সময় হয়ে গেছে। কেয়ামতের সময়। ওঠো, নইলে বন্যা…” বন্যা শোনার পর আর ঘুমোনর মানে হয় না। উঠতে হ’ল। চশমা খোঁজার সময় নেই। স্যুইচবোর্ড হাতড়ানোর সময় নেই। বন্যা। ছায়াগুলো একটা হতাশ, “এর দ্বারা কিস্যু হবে না” মুখ করে দাঁড়িয়ে। একটু দরজাটা দেখিয়ে দিতে পারত? দরজার কানায় ঠোকর খেয়ে এগোলাম। ছায়াগুলো পিছু নিয়েছে। সেরেছে। বাথরুমেও ঢুকবে নাকি? ভাবার সময় নেই। বন্যা। তিন বছরের অচেনা বাড়িতে হাতল ঘুরিয়ে বাথরুমে ঢুকেই একটা খুব চেনা গন্ধ পেলাম। স্পষ্ট। ভারী। চেনা। এ গন্ধর এখানে থাকার কথা নয়।
বীন্স আর বরবটি গুলিয়ে যেত। আর খাবার পাতে বরবটি আর কাঁচা লঙ্কা। কতবার যে বরবটি ভেবে লঙ্কা কেটেছি দাঁতে… মা বরবটি কাটছে বঁটিতে। আমাদের বাড়িতে দু’টো বঁটি, আমিষ আর নিরামিষ। খাবার ঘরের মেঝেতে সবজি ছড়ানো। বাজারের সবজি। ফ্রিজে তোলা হয়নি। আমাকে তুলতে বলেছিল। আমি খেলা দেখছি। বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। নিজের রিডিং গ্লাস খুঁজে পায়নি। মায়েরটা পরে দেখছে। নাকের ডগায় রিডিং গ্লাস, আর চোখ টেরিয়ে স্কোর। “টিভির অত কাছে বসিস না, চোখটা খাবি।” আর চোখ, ১১৩/১। হেডেনটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারি না। “আছে কাগওওওজ, খাতাওলা বওওইওলা” বলতে বলতে মহম্মদ ঘুরে গেলো। রবি শাস্ত্রীটা আহাম্মক। কী যে বলে! ও সৌরভের থেকে বেশি জানে? মা আবার চেঁচালো। “তুই যাবি কিনা স্নানে?” আমি ভাঙা রেকর্ডের মত বললাম “আর একটা ওভার। দাঁড়াও না!” গত ষোলো ওভার ধরেই বলছি। মা বলল “আর একটাও না। এক্ষুণি স্নানে যাবি তুই। আরে, ওরা চলে আসবে তো!” উফফ। কাণ্ডজ্ঞানহীন হরভজন। ওয়াইড। “গেলি কিনা স্নানে তুই? করে নিয়ে দেখ?!” মাঠে পেপ্সির গাড়ি নেমেছে। ড্রিঙ্কস। উঠলাম। আলনা থেকে স্যাণ্ডো গেঞ্জিটা নামালাম। মা বলল “এইটা পরে থাকবি ওদের সামনে? কোনও ইয়ে নেই তোর? দেখ খাটের উপর চেক কাটা জামাটা রেখেছি।” নিলাম। “ভালো করে তেল দিবি চুলে।” ছাই দেবো।
টুক করে ঘাড় বাড়িয়ে দেখে নিলাম খেলা চালু হয়েছে কিনা। হয়নি। মারুতি ওমনির অ্যাড হচ্ছে। ছিটকিনি খুলে বাথরুমে ঢুকলাম। একটা খুব চেনা গন্ধে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। স্পষ্ট। ভারী। চেনা। আমাদের বাড়িতে দু’টো সাবানের খোপ। একটা রোজকার। একটা অতিথি এলে। ইস্পেশাল। চৌকো খাপে গোল সাবান। মাইসোর স্যাণ্ডাল সোপ।
ঘোর কাটল। ছায়াগুলো নেই আর। আলো জ্বাললাম। বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা করলাম। বেসিনের পাশে লাল সবুজ হলুদ প্যাকেট। মুখ বের করে থাকা একটুকরো সাবান। এ পরবাসে এ সাবান পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। চিন্তাশক্তি ফিরতে আরো সময় লাগল খানিক। এ জিনিস আমার নয়। অতএব এ জিনিস আমার সহবাসিন্দার। সে সদ্য বাড়ি থেকে ফিরেছে। বাড়ি। দেশ। দেশের বাড়ি। মাইসোর স্যাণ্ডাল সোপ কলকাতার একচেটিয়া নয়।
বাড়ির। একচেটিয়া।
বন্যা রোধ করা গেল না।