কনুই দোতলার পাঁচিলের উপর রেখে গাড়ি গুনি। পাঁচ। সতেরো। একচল্লিশ। ময়লা গোলাপি আর অস্বচ্ছ নীল এ ঘেঁটে আছে আকাশটা। দু’টো হলুদ হ্যালোজেনের বাতিস্তম্ভের মধ্যের তারে একটা ছোট্ট ব্লু জে। চৌষট্টি। বিরাশি। তিরাশি। গোলাপিটা নেই আর। গোড়ালি উঁচু করে দাঁড়ালেও নেই। নীলটা ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বেঁধে কালচে। একটু চিনি ছাড়া লাল চা হলে ভালো হত। টি-ব্যাগের নয়। সিটিসি। বগবগে জলের মধ্যে দু’চামচ। ছাঁকনি দিয়ে কাপ এ। চুরাশি। গাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে। একটা ভালোরকম মাতাল বেশ উচ্চস্বরে শিস দিতে দিতে সামনের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে। তালে। কীসের একটা তালে। শিসটা খুব চেনা। বড্ড। তার অবয়ব মিলিয়ে যাবার পরেও আমার ঠোঁটে সুরটা থেকে যায়। পঁচাশি। পুলিশের গাড়ি। আমারও তো ইচ্ছে করে। আকণ্ঠ মাতাল হয়ে হুঁশ হারিয়ে গুলাবী আঁখে গাইতে গাইতে হাঁটি, রেললাইনের পাশে, বা ওইরকম একটা হ্যালোজেনের কাণ্ডে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ল্যাম্পপোস্টগুলো কে গাছ মনে হয়। আলোগুলোকে ফল। সেই আলোর ছায়ায় ঘুম। মুখ থেকে গাঢ় ধোঁয়া বেরোবে। গা থেকে সস্তা মদের দুর্গন্ধ। চিন্তাশক্তিহীন। ঠোঁট থেকে শিস। ম্যায় লুট গয়া, মানকে দিল কা কাহা… ছিয়াশি। চা না হলে চলছে না। গলায় বড়শি বেঁধা পোকা মনে হয় নিজেকে। একটা ইয়াব্বড় বোয়াল জিভ চাটছে। তাচ্চেও বড় একটা হুমদো মানুষ ভুরু কুঁচকে বলছে “এ চার তাজা চার”। বেচারা বোয়াল। চার হতে চাইনি। সাতাশি পাতার বুকমার্ক হতে চেয়েছিলাম। বেল পাকলে উদাসীন কাক, আর বেল বাজলে বইএর ভিতর চুলের ফিতে গুঁজে দৌড়ে উঠে দরজা খুলতে যাওয়া। সেই ফিতে হতে চেয়েছিলাম। “মাআআআ, কৃষ্ণাকাকিমা এসেছেএএএ” বলে বিছানায় ডিগবাজি খেয়ে “আলেখ্য বলিল “কোথায় গিয়েছিলে? বারবার কেমন উধাও হয়ে যাও…”
অষ্টাশি। নীলটা এখন পুরো কালো। মাথাটা আর ভারী হলে ও’পারে উলটে পড়ে যাবো। মাথা পিছনে নিতে পারছি না। ভারী। উলটে পড়তে পারছি না। চিঠি লিখে রাখা নেই। “আমি যদি নিষ্ঠুর হয়ে থাকি, কখনও, সজ্ঞানে হই নি। ক্ষমা কোরো।” বাতাস ঘন কেন? ” মিথ্যে কি বলেছি? বলে থাকলেও তোমায় নয়। নয়। নয়।” চা পাতা পোড়ার গন্ধ শুঁকেছ কখনও? মিষ্টি গন্ধ হয়। চল না, একটু হেঁটে আসি। কিন্তু ঘরের চটি পরে আছি যে! ধুস, তাতে কী? চল! রাত্রি থেকে রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকের প্রথম গলিটা ধরে দুপুরের দিকে যাওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে, কিন্তু হাঁটলে বোধহয় পুলিশ ধরবে না। কিন্তু অনেকখানি চড়াই। ঘি রঙের ফ্রক চাদর জড়িয়ে বরের বুকে মুখ গুঁজে বাড়ি ঢুকছে। মৃত সন্তান প্রসব করেছে সে, দুপুরে। সে করেছে? আমি করিনি? আড়াই বছর দাম ছিলো সময়ের। মরে গেছে। তার গাছের মত গজিয়ে ওঠা অ্যান্টলার টাঙানো আছে আমার বসবার ঘরে। দুপুর এর মোড় থেকে দু’টো বাড়ি ছেড়ে তৃতীয়টার গাঁ ঘেঁষে যে গলিটা, ওটা ধরলে সকাল। সকাল। সব ঠিক করে দেবো। কখনও। কোনও একদিন। সে রাস্তা উল্টোদিকে। এখনও খোলেনি। জিপিএস এ দেখায় না। সকালটা দেখাচ্ছে। সাদা দেওয়াল। বাদামি মেঝে। রঙের গন্ধ। বৃষ্টি নামবে, ফিরবি?
ভালোলাগছে না। সে’টা অভ্যেস ও হচ্ছে না। তুমি কি চাও বলতো? কাঠের ক্রাচ টা পাশে রেখে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বুড়ো ভিখিরি বলল “ডলার তিনেক হলেই চলবে। দুই? এক? দু’টো কোয়ার্টার?” দিলুম। “আর তুমি কী চাও হে? সঙ্গ? সঙ্গী? বেড়ে আব্দার তো তোমার হে ছোকড়া? অত চাইতে নেই। গেম অফ থ্রোন্স দেখ গে।” বিড়বিড়রত লোকটাকে পিছনে ফেলে হাঁটতে থাকি। নো পার্কিং এ দাঁড় করানো ঊননব্বই নম্বর গাড়িতে হেলান দেওয়া সাটিন এর সুন্দরী মেয়েটি হাঁক পাড়ে। “কেন চাইবে না বলো তো? কেন চাইবে না? সঙ্গ চাও। দশমিকের পর চার সংখ্যার প্রিসিশনে পেগ বানিয়ে দেবার সঙ্গ চাও। ষাট দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য। করেক্ট আপ টু ফোর প্লেসেস আফটার ডেসিমাল। আকথা কুকথা আর ছেনালির সঙ্গ চাও। অপূর্ব রায়ের দর্শন আর লেনার্ড কোহেনের বিশ্লেষণের সঙ্গ চাও। নিঃশ্বাস গভীর করে বুকের তিলে হাত বোলানোর সঙ্গ চাও। চাইবে না কেন বলো তো?” তার ফোন বাজে। রাতের রাস্তা পেরোই। পকেট হাতড়ে চাবি খুঁজি।
তারে বসা ব্লু জে আর শিস দেওয়া পাঁড় মাতালটার মত করে সময় ভুলতে ইচ্ছে করে।
একটু চা বসাই।