“এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কয়েকটা টেস্ট হবে। বিকেলের দিকে আসুন।”
গাড়িটার চাকা ঘিরে কাদার ছিটে। বাঁ দিকের সামনের দরজাটা হাট করে খোলা। ছাই-ইউনিফর্মের ড্রাইভার সিট হেলিয়ে দিয়ে স্টিয়ারিং এর উপর পা তুলে ঘুমোচ্ছে। রেডিওটা তবে কার জন্য খোলা? অভীক গাছের নীচের বেদীটায় বসে ড্রাইভারটাকে হিংসে করছিলো। খুব সহজে ঘুম লেখা নেই তার কপালে। যেটা আছে, সেটা একটা পেটরোগা কাকের ইয়ে। কপাল জুড়ে মোটা ধারায় উষ্ণ আধা-কঠিন-আধা-তরল জিনিসটা গড়িয়ে পড়ছিলো। রুমালটা ফেলে দিতে হবে।
বিকেলের দিক হতে বেশ খানিক সময় আছে। তাকে প্রহরীত্ব থেকে উদ্ধার করতেও চট করে কেউ আসবে না। গাছের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে ঝিমোনোর চেষ্টা করল অভীক। কিন্তু রাস্তার উলটো দিকের বৃহৎ বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংটায় পাহাড় এ ব এ শুন্য র লিখেছে ওরা। পাহার। বারবার চোখ পড়ে যাচ্ছে। খুব পীড়া দেয় এগুলো অভীককে। শেষ দুপুরের কমলা রঙের শহরে ক্লান্ত, অবসন্ন ছেলেটার আস্রবণ হয়। রাস্তার ওপারের বাড়িগুলোর অবয়ব পড়ে থাকে। রাস্তায় জোয়ার আসে। ফিরতি ট্র্যাফিক। বাবলু’জ লেখা দোকানটা ঝাঁপ খোলে। ডিমভাজার গন্ধ আসে। বড্ড পাঁচমিশেলি গান হচ্ছে এফএম চ্যানেলটায়। অ্যায় জিন্দেগী, গলে লাগালে। গানটা ভালো লাগত। লাগে। সদ্মা। পুনর্শিশুতোভব শ্রীদেবী। ধৈর্যশীল কমল হাসান। ম্যায়নে ভি তেরে হর এক গম কো গলে সে লগায়া হ্যায়, হ্যায় না? অমূলক জ্ঞান মনে হচ্ছে গানটাকে এখন। অপেক্ষার তুমি কী বোঝো হে? প্রেয়সীর পথ চেয়ে অপেক্ষা নয়। মানে, এই মুহূর্তে নয়। একটা দুর্বোধ্য রিপোর্টের। কয়েকটা সিদ্ধান্তের। একটা বিছানার। বা সোফার। একটু গা এলাবার। দু’চোখের পাতা এক করবার। একটু আশ্বাসের। খানিক শান্তির। বিকেল অবধি দান দেওয়ার নেই অভীকের। কুড়িয়ে পাওয়া এক প্যাকেট শান্তি। রেডিওর মেয়েটা হিজিবিজি বকছে।
সূর্য্যটা হোর্ডিং এর ঠিক পিছনে। ছবির ফ্রেমের পিছনে টিকটিকি লুকোনর মত করে লুকিয়েছে। এই একটা কাজের কাজ করেছে হোর্ডিংটা। কী পিঁপড়ে না বেফিক্রে, কী একটা বলে চেঁচাচ্ছে রেডিওতে। মাছি তাড়ানোর মত করে বা মুখের সামনে থেকে সিগারেটের ধোঁয়া সরানোর ভঙ্গিতে গানটাকে সরাবার চেষ্টা করল অভীক। ইলেক্ট্রিকের তারে ক্যরশফের নক্শা। ঘটঘটে ট্রামের স্ফুলিঙ্গ। অধৈর্যের ঘড়িযাপন। ফুটপাথে চৌকি একটা আছে, সেটা আপন বাপন নয়, হিন্দুস্তানী দোকানওলার। নইলে কষে চাপন করা যেত। ধ্যাত্তেরি। একটা স্কুটার হেলে পড়েছে ট্যাক্সির ঘাড়ে। তুই বেড়াল না মুই বেড়াল। শান্তি নেই। ক’টা বাজল?
বাদামী কুকুরটা অভীককে দেখিয়ে দেখিয়ে হাই তুলল। পিছনের পা দিয়ে কান চুলকিয়ে শুয়ে পড়ল ছায়া দেখে। টিফিনকৌটো কোন জন্মে খালি। রোলের দোকান অবধি যেতে ইচ্ছে করছে না। রাস্তা পেরোতে অনীহা। আচ্ছা, রাত আর সকালের মাঝে ভোর। বিকেল আর সন্ধ্যের মধ্যে গোধূলি। সকাল আর দুপুরের মধ্যে? দুপুর আর বিকেল? সন্ধ্যে আর রাত? অন্যায় এসব। গলার কাছটা কী’রম উদাস উদাস লাগছে। ফোনে নেট নেই। না থাকলে ছোটবেলার বাড়িতে লোডশেডিং এর কথা মনে পড়ে। কুকুরের হাই ও ছোঁয়াচে? ক’টা বাজল? দুপুরটা দুপুরতর হচ্ছে। এক্ষুণি বেড়া টপকে বিকেল হয়ে যাবে। উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত ডানা করে আড়মোড়া ভাঙে অভীক। ন্যাতাসম জামা। অসমান হয়ে ঝুলে থাকা ওড়না। সেই জামা আর ওড়নার মাঝখানে সন্ধির মাত্র আভাসটুকু। থপথপে হাঁটা। বোরোলীনের মত হাসি। “কীরে ডাক্তার কী বলছে?”
“বড়ে আচ্ছে লগ্তে হ্যায়।”
“ক্যায়া?”
“ইয়ে ধরতী। ইয়ে নদীয়া। ইয়ে র্যয়না।”
“অর?”
উত্তরটা জানা। তবু শোনবার ইচ্ছে। সেই ইচ্ছেটুকুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাবার ইচ্ছে। সব মিলিয়ে এক প্রবল ভালোলাগা। একটা পৌনে বিকেলে ভালোলাগার আর কীই বা আছে। তবু। “অর?”
“অর তুম।”
“বলেনি কিছু। নাকউঁচু ডাক্তার। বিকেলে আসতে বলেছে।”
“চহ্।”