উনুন থেকে ওঠা ভেজা কয়লার সাদা ধোঁয়ায় শ্যাওলা রঙের বিকেলটা আরেকটু ঘষে গেছে। উত্তাপের অভাবে সালোকসংশ্লেষ কিছু কম হচ্ছে। শুধু অটোর মাঝখানে বসে দু’দিকের ওম শুষে নিচ্ছিল ছেলেটা। শহরটা কেমন থম মেরে আছে। ফোন কানে ক্যালরব্যালর নেই। একটু জায়গা চেয়ে লাগাতার হর্ন নেই। নিরাসক্ত দিনযাপন। নীচু তারে বাঁধা। বরং অটোওলা একটু গলা তুলে “খুচরো দেবেন” বললে বেমানান লাগত। বদলে সে থলের মধ্যে থেকে খুঁজে তিনটে টাকা বের করে দিয়ে দিলো ছেলেটার হাতে। ছপ করে ফুটপাথ লাগোয়া কাদাজলে উত্তরণ ঘটল তার। বিশেষ হেরফের ঘটল না তাতে। বৃষ্টি নামেনি এখনও। এখনও না। শ্যাওলা আলোয় ছেয়ে আছে কলকাতার আকাশ।

“ওরা বাইরে কেন ঝোলে অমন করে? ভয় করে না? পড়ে যায় যদি?”
“এটা ঠিক না। উলটো দিকের তিনটে ট্রেন চলে গেলো। আমরা কি মানুষ নই?”
“ওই দেখ চটিওলা। চটি কিনবি?”
“এদিকে শেয়ালদা?”
“উলটো দিকেই বেশি ভিড়। সবাই বাড়ি যাচ্ছে, না?।”
ঘন চুল। আলটপকা ফোঁটা তাই মাথা অবধি পৌঁছয় না, চুলের ভিড়ে হারিয়ে যায়। সেই আর্দ্রতা টেনে নিলে কেমন অগোছালো, এলোমেলো হয়ে থাকে মাথাটা। এক দুটো বেয়াদপি করে ঠোঁটের ভিতর ঢুকতে চায়। টিপটা কখন খুলে গেছে। বৃষ্টিটা ধরেছে একটু। একজনের ডানকাঁধ ভিজে। অন্যজনের বাঁ। ছাতা থেকে প্ল্যাটফর্মে টুপটুপ করে জল ঝরে। ওড়নাটা নাকের উপর টেনে নেয় খেলাচ্ছলে। মর্জিনার মত দেখায় তখন। ছেলেটা হাসে। “ওই যে। আসছে।”
নিতান্ত অনিচ্ছায় অথবা টইটম্বুর মাতালের মত ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢোকে। তার গর্জনটাও মিয়ে গেছে কেমন। দরজার সামনের ভিড়টা পাতলা হয়ে যায়। জানালাপারের খয়েরী সিংহাসনে উপবিষ্ট হন মর্জিনা আবদাল্লা। ঘটিগরমওলা সতর্ক করে দেয়, এ কিন্তু শেয়ালদা যাচ্ছে না, মাঝেরহাট। হাটের শেষে তাদের কোনও কাজ নেই, কোথায় শুরু, মনে নেই তাও। মাঝেরহাটই সই।
খুব সাধারণ কিছু মুখ। চোখ সরালেই মনে থাকেনা আর কিছু। সেটুকুও খালি হয়ে যায় বালিগঞ্জে। “এবার উলটো দিকে যাবে ট্রেনটা।” হয়ত এখনও অনেককিছু দেখানো বাকি এই শহরে…
ভেজা লাইনের উপর বোল তুলে এগোতে থাকে ট্রেনটা। “চল, দরজায় গিয়ে দাঁড়াই।” একটা ভীষণ বুনো অথচ শহুরে গন্ধ আসে হাওয়ায়। কচুরিপানা আর মোবিল। সোঁদা মাটি আর ভেজা পিচ। হেলানের আশ্রয় ছেড়ে ছেলেটা হঠাৎই মেয়েটার মুখ টেনে নেয়। একটা সংক্ষিপ্ত চুমুর আকস্মিকতা উদযাপন করে শ্যাওলা শহর।
গল্পটা কোথাও যায় না। দানা বাঁধে না। টুকরো টুকরো হয়ে বিকেলের গহ্বরে মিলিয়ে যায়। চোখ বুলিয়ে মনে কামরায় কারুরই তেমন কোথাও যাওয়ার নেই।
ঘটিগরমওলা মেঝেয় বসে হেলান দিয়ে খুচরো গোনে। ওই কোনের পরণে উপরের তিনটে বোতাম ছাড়া ময়লা শার্ট লোকটা মিয়ানো বিড়ি ধরাবার চেষ্টায় রত। বছর সাতেকের ভিখিরি মেয়েটা তার ন্যাংটো বাচ্ছা বোনটাকে দুই পায়ের মাঝখানে আটকে রেখে কিছু ভাবছে।
আবদাল্লা দরজায় দাঁড়িয়ে মর্জিনার ভুরুর পাল্লা মাপে। এক দিকে মর্জিনা। একদিকে উলটো দিকের মায়ার্স্কের শিপমেন্ট বোঝাই অন্তহীন মালগাড়ি। মর্জিনার চোখে দুই প্রলেপ প্রতিবিম্ব।
 “আমায় ধরে দাঁড়া। পড়ে যাবি।”
“এই জন্য সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে যায়?”
কেউ কোথাও যায় না।
কেউ কোথাও যাচ্ছে না।
এটা কোথাও না যাওয়ার ট্রেন।