মাঝেমাঝে মনে হত দুপুর তিনটের বৃষ্টি। পূর্বাভাসহীন। এঁটো বাসন রান্নাঘরের বেসিনে রেখে ওর উপরেই হাত ধুয়ে একটা খুব গুরুত্বহীন কিছুর পাতা ওলটাতে ওলটাতে উপুর হয়ে অবসাদের ঘুম। বা ভারী কিছু, জানালার ধারে, অনেক পাতা পড়ার পর আবিষ্কার করা যে কেবল পাতাই উলটেছি, মাথায় একটা বানানো, কাল্পনিক সংলাপ রিপ্লে করে চলেছি সমান্তরালে, তাই অক্ষর একটাও ঢোকেনি মাথায়। তারপর চোখ জুড়িয়ে আসা। পর্দা টেনে চশমাটা বই এর উপর রেখে একটা গা-ঢাকা দেওয়া ঘুম। তারপর অবচেতনে বৃষ্টি ফোঁটার রাস্তা ছোঁয়ার শব্দ, পর্দা উড়িয়ে অনুপ্রবেশ করা জোলো হাওয়া, কারেন্ট গিয়ে পাখা বন্ধ সব মিলিয়ে একটা কলিং বেল। বিছানা হাতড়ে চশমা খুঁজে বারান্দায় দাঁড়াই। এর মধ্যেই পাপোশ ভিজে গেছে। জুতো গুলো ভিতরদিকে সরিয়ে রাখি। মাথার ভিতর ছায়াসূর্য্যর কালো মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর। এসো, এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে। দুপুর তিনটে। লোডশেডিং। আর বৃষ্টি। সেইরকম মনে হত ওকে। আমার গভীরতম অপ্রস্তুতির মাঝখানে ও আসবে। পাজামার তলায় আমি বিচলিত, কারণ অন্তর্বাস ঝুলছে আলনার উপর, সর্বসমক্ষে, পতাকার মতো। “উফ! কী গরম! পাখাটা আর জোরে হয় না?” আমার কোলের উপর থেকে বালিশটা টেনে আমায় প্রকট করে ও শুয়ে পড়বে আমার জঞ্জালময় বিছানায়। আমি একটু সময় নেবো ধাতস্থ হতে। চোখে চোখ এড়াবো। স্নানঘরে ছিটকিনি দেবো। জানালার গ্রিল থেকে দুই হাত বাড়িয়ে শহরময় বৃষ্টির আমার ভাগটুকু শুষে নেবো আমি। আমি জানি, সবটা আমার নয়। যতটুকু আমার, ছাড়ব কেন? বেরিয়ে এসে দেখব চা ফুটছে অ্যালুমিনিয়ামের সসপ্যানে। শেষ দুপুরের পর্দাছেঁচা রোদ ওর মুখের বাঁ দিকটা আলো করেছে। ওর চোখ বলছে, সেটা ও জানে। “আমার একটা ছবি তুলে দিবি?” খালি পায়ে বারান্দার বাইরে নামব। অনধিকার বৃষ্টি মাখব খানিক। চুমু খাবো একটা। আরো একটা তারপর।

খুব ক্লান্ত হয়ে থামবে বৃষ্টিটা। হঠাৎ থামা নয়, ফেড আউট। টিপটিপ। আমি গামছায় মুখ ঢেকে মাথা মুছব। রান্নাঘর থেকে গন্ধ পাবো সিগারেটের। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখব বিছানার চাদরের স্তূপ থেকে ওর অনাবৃত পিঠটা বেরিয়ে আছে। বালিশে মিশে আছে বুক। খাটের পাশের জানালা দিয়ে রাস্তার ওপারের জানালার উপর নজরদারী চলছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে হঠাৎ ঘুরে বলবে “এই দ্যাখ, ওরা ঝগড়া করছে!” আমি ওর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকব। “খালি ওই!” বলে ও বালিশটা টেনে নেবে আবার। হাতল ভাঙা চায়ের কাপে ছাই ফেলবে। সিগারেটটা ওর আঙুলের অংশ মনে হয়। ধোঁয়া আমার সহ্য হয় না। তাই হাত বাড়িয়ে বলব, “এক টান দে আমায়।”