(১)

বেরিয়ে আসার রকমফের হয়।

একটা রকম দমকা। “পথ ছাড়ো মা” বলে কনুই ছাড়িয়ে নিয়ে “যেতে দাও ওকে, দেখি কত বড় আস্পদ্দা” আর “খোকা যাসনে” কে দড়াম করে দরজার পিছনে ফেলে হনহনিয়ে রিকশাস্ট্যান্ড অবধি এসে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলা। তার ঘন্টা চারেক বাদে গোষ্ঠ পালের পায়ের তলায় বসে উপলব্ধি করা, অনেক হয়েছে। উপলব্ধিগুলো সময়ফেরে আসতে পারে। মিনিবাসের কন্ডাকটর টিকিট চাইলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার সময় আসতে পারে। শেয়ালদায় দুই’সেকেণ্ডে সাত জনের ধাক্কা খেয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের হোঁতকা ইঞ্জিনটার কান ফাটানো হুইসিলে আসতে পারে। ডানকুনি লোকালের বেরিয়ে আসাটাও বেরিয়ে আসা কিন্তু।

 

আরেকটা রকম মৃদু। দৃঢ়। সারারাত জেগে থাকা। ভোর চারটের আলোয় চিঠি লেখা। মশারির তলায়, বালিশের উপর সেটা সাজিয়ে দেওয়ালে পেরেকের থেকে চাবিটা নিয়ে যতটা সম্ভব কম আওয়াজ করে গেট খুলে ফের তালা আটকে চাবি ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে এক বারও পিছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে আসা। এ সমস্ত বেরিয়ে আসায় বারবার চশমা মুছতে হতে পারে। ঘনঘন সিগারেট ধরাতে হতে পারে। অস্বস্তির চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। বিশ্লেষণ, রোমন্থন ভিড় করে আসে। চারপাশ ঘোরের অস্বচ্ছতায় কেটে যায়। কখনও কোনও বাহ্যিক আঙুল খোঁচাতে সম্বিৎ ফেরে। বত্রিশটা কেন আর একটা কীভাবে’র উত্তর যদ্দূর টানে। তারপর একসময় ভাঁটি। আটটার বেশি কেন’র উত্তর মেলে না। এ’টুকু বোঝা যায়, এ কুমীরডাঙা জিতবার  নয়, সুন্দরবন অবধি হাঁটলেও নয়। কীভাবেটার উত্তর একটাই, আর সেটা সর্বজনীন। মধ্যস্থতা। মঝঝিম পন্থা। ত্রিপিটকে লেখা আছে। সিদ্ধার্থ একটা ভীষণ অন্যরকম বেরোনো বেরিয়েছিলেন।

 

একটা বেরোনোর নাম প্রত্যাখ্যান। সেই বেরোনোর মাথা নীচু, বুকে চিবুকে একাকার। সেই বেরোনো হজম হওয়া অবধি পানিহাটির ঘাটে বসে থাকে। আমার দ্বারা হবে না। শেষ বিকেলের চড়া রোদ গঙ্গায় ঝিকমিক করে। ভটভটি ভটভটায়। হবে না, আমার দ্বারা। রোজ রোজ এই একই অপমান হিউমিলিয়েশন সহ্য হয় না। “ধ্যার বাল যা না, বলছি তো খাবো না বাদাম।” “ভদ্দরভাবে কতা বলুন”, বাদামওলা সরে যায় ছায়ায়। কেন, কেন, কেন? কেন পড়িনি ফোর্থ চ্যাপ্টারটা? কেন করবে ও ইনফোসিসের কুত্তাটাকে বিয়ে? রোদ নামে। খিদে পায়। দু’টাকার বাদাম, সান্ত্বনা ফ্রি, খিস্তির পরেও। “বাড়ি যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

 

কিছু বেরোনো ছ’টার সময় স্টেশনের বড়ঘড়িটার তলায় অপেক্ষা করে। ঘড়ি দেখে ঘনঘন। ইতিউতি চায়। আবার চোখে পড়ার ভয় সামলায় নিজেকে। নখ খায়। তারপর হঠাৎ কী ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ। “ভেবে দেখো। এখনও সময় আছে। চাক-” “তোমার সংশয় হচ্ছে বুঝি?” একটু থেমে উত্তর আসে “ক’দিন লাগবে ওদের মেনে নিতে?” অস্পষ্ট ঘোষণার মধ্যে ফিসফিস ওঠে। “যদ্দিন, তদ্দিন!” এই বেরোনোগুলো বউবাজারের মেস থেকে কানটানা খেয়ে  ফিরে আসে ব্যারাকপুরে, উত্তরপাড়ায়। কানমোলা। থাপ্পর। আঙুলবাজি। গলায় গামছা, গায়ে হলুদ। “বলেছিলাম!” “ভাগ্যিস!”

 

(২)

 

জানালার গোড়ায় চা-টা রেখে নিমকি বিস্কুটের প্যাকেটটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ছিল জগাই। দু’পায়ের মাঝখানে প্যাকেটটা রেখে ফোকর থেকে একখানা বিস্কুট তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে বের করে বাঁ হাতে জানালা থেকে চা-টা তুলতে যাবে, ঠিক তখনই উলটো দিক থেকে একটা ট্রেন বেজায় হুঙ্কার দিয়ে জগাইএর পিলের ঠাকুর্দা চমকিয়ে হুড়মুড় করে ওদের ট্রেনটা পেরিয়ে গেল। আঁতকে উঠেছিল জগাই। খানিকটা চা চলকে পড়ল এদিক ওদিক। চারপাশে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত হল সে। এরকম ঘাড়ের কাছে এসে না বলে কয়ে হর্ন দেবার মানে হয়? চা-নিমকি আর জানালার বাইরে মন দেওয়ায় মনস্থির করল সে। বাবা জানালার ধারে বসতে দিত না। দিলেও ট্রেনের ল্যাজার দিকে মুখ করে বসতে হত। নইলে নাকি হাওয়ায় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। বড় হওয়ার এটা একটা ভালো দিক। মাড়োয়ারি পরিবারের বাচ্চা মেয়েটা এতক্ষণ জানালায় থুতনি দিয়ে ধারটা দখল করে ছিল। মা মুখ ধোয়াতে নিয়ে গেছে। গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে এবার জগাই। আর ছাড়ান নয়।

 

পা’দুটো উলটো দিকের সিটের উপর তুলে দিয়ে মাথা এলিয়ে দিলো সে। ট্রেনটা বাঁদিকে বেঁকলে পুরো শরীরটা দেখা যায়। মোড়ল ইঞ্জিনটা উপরের তার ছুঁয়ে। তারপর একটা লাগেজ ভ্যান। তারপর সার দিয়ে জানলার নক্সা। ছোটবেলার ট্রেনগুলো লাল হত। কবে যে হঠাৎ ডোরাকাটা নীল হয়ে গেল, মনে পড়ে না। একটা কোনও স্টেশন আসছে। স্টেশন আসার আগের এই একটুখানি এলাকা খুব মন কেমন করায় জগাইকে। কয়েকটা পরিত্যক্ত লাইন। তাতে আগাছা। একটা লাইন চলছিল দিব্যি, তাকে জোর করে থামিয়ে দেওয়া হল গোলপোস্টের মত তক্তা তুলে। আরেকটা এসে মিশে গেল চলতিটার সাথে। ভাল্লাগে? এক’দুটো বেওয়ারিশ ওয়াগন বা কামরা শিকর গেড়ে জবুথবু হয়ে বসে। তাদের গায়ে রাজা লাভস প্রিয়া লেখা। ট্রেনটা গতি কমাচ্ছে। একটা মেঠো রাস্তা লেভেল ক্রসিং এ অগাধ ধৈর্য্যে অপেক্ষমান। তেমন কোথাও যাওয়ার নেই রাস্তাটার। একটা পিছন উঁচু অটো ফুলকপি, হাফপ্যান্ট বাচ্চা আর একটা গলায় দড়ি ছাগল পেটে সেই রাস্তার রাহী। ধাতব ক্যাঁচকোঁচ। একটা সতর্কবাহী ভোঁ। হাঁটুর কাছে বাচ্চাটা এসে জুলজুল করে তাকিয়ে। জগাই গলবে না। জানালার ধারের ব্যাপারে মেল্টিং পয়েন্ট হাই। বাবাটা টেনে নিল কোলে। জগাই ফের মন দিল বাইরে। ট্রেনটা থেমে গেছে।

 

ট্রেনটা থেমে আছে। যদিও কারুর বিশেষ উচ্চবাচ্য নেই। জগাই উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাচ্চাকে দ্বিপ্রাহরিক ঘুম পাড়ানো চলছে। ধারটা দখল হবার সম্ভবনা নেই। দুই হাতে দুটো হাতল ধরে ঝুঁকল জগাই। ট্রেনটা নাক বরাবর সোজা। সিগনাল লাল। স্টেশনটা চোখের পাল্লায় নেই, কিন্তু কাছেই। লাইনের সমান্তরাল সেই মেঠো রাস্তাটা। সেটাই কিনা কে জানে। এক’দুটো নির্লিপ্ত সাইকেল। এইটা ভেবে পায়না জগাই। কেউ কী করে ট্রেন দেখে এত উদাসীন থাকতে পারে? সে হলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত অনেকক্ষণ। চোখ ছোট করে নাম দেখত ওই একফালি হলুদ নেমপ্লেটে। পিছন ঘুরে উলটো দিকের দরজা দিয়ে ঝোঁকা মনস্থির করল জগাই। এইপারে ডাউন লাইনটা। আর… জগাই ঢোঁক গিলল। একটা সিগনাল কেবিন। পরিত্যক্ত। ইঁটের পাঁজর বের করা লাল রঙের ছোট্ট দোতলা বাড়ি। গায়ে হলুদের মধ্যে কালোয় লেখা ABANDONED. পিছনে আবছা হয়ে আসা গঙ্গাধরপুর ইস্ট। জগাই এর মনে হল সে পৌঁছে গেছে। তার টিকিটে লেখা মোগলসরাই। কিন্তু আদতে তার এখানেই আসার কথা। এখানেই নামার কথা তার। তাই…

 

সিগনাল কেবিনের পিছনে ফাঁকা মাঠে একটা ছোট পাহাড়। একটাই পাহাড়। দূরদূরান্তে আর কোনও টিলা অবধি নেই। গমের ক্ষেত। তার মাঝখানে পাহাড়। তার সামনে কঙ্কালসার গঙ্গাধরপুর ইস্ট। কী’করে যেন ব্যাগটা জগাই এর পিঠে উঠে এসেছে। একটু মন খারাপ হল জগাই এর। জানালার ধারটা ফেলে আসতে হবে। সে যাক, যেতই…  পাদানি হাতড়ে নামল সে, পেল্লায় উঁচু ট্রেন থেকে। পাথরকুচি পেরিয়ে পাশের সবুজে দাঁড়াল। নির্নিমেষে ট্রেনটাকে দেখল খানিক। তারপর হাঁটতে লাগল অদ্বিতীয় পাহাড়টার দিকে। অর্ফিয়ুস পিছন ফিরে চেয়েছিলেন। জগাই চাইলো না। প্রতিটা পা ফেলার সময় মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হুইসিল শুনতে পাবে। পেলো না। পাহাড়টা ট্রেন থেকে যত কাছে মনে হচ্ছিল, আদপেই অত না। বেশ দূরে। এবং আকারে বৃহত্তর। বাঁ হাতে ঘাম মুছে উঠতে লাগল জগাই। পিছনে না তাকিয়ে। ওঠার রাস্তা আছে। নিয়মিত ওঠানামার প্রমাণ ছেটানো। একবারেই উঠতে পারল জগাই। চ্যাপ্টা মাথা পাহাড়। তার উপর থেবড়ে বসল সে। ভালো লাগছে এখান থেকে পৃথিবীটা। সোজা চিকমিকি শহর পেরিয়ে সূর্য্য ডুবছে। গোলাপি অন্ধকার। ডাইনে দূরে স্টেশনটার আলো দেখা যাচ্ছে। লম্বা টানা হুইসল পড়ল। খেলনার মত লাগছে ট্রেনটা। অন্ধকারে ডোবা। খোলা জানালার আলোর সারি। নড়ে উঠল আলোগুলো। কমলা আঁধারে আশ্চর্যরকম শৃঙ্খলাবদ্ধ জোনাকির মত সরলরেখায় চলতে আরম্ভ করল ট্রেনটা।

 

হঠাৎ পেটের ভিতর গুলিয়ে উঠল জগাই এর। “এই দাঁড়াও” ঢাল বেয়ে ছুট দিলো সে। “দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও। আমি ফিরব তো!”

 

(৩)

 

এদিক ওদিক না তাকিয়েই ধপ করে বালিতে বসে পড়ল অন্তু। বসেই আঁক করে উঠল। পায়ে ফুটল কিছু? আধা আঁধারে হাতড়ে একটা কাঁটা পেলো সে। পাজামায় আটকে ছিল। মনসাঝোপ পেরোনোর সময় পাজামায় ঝুলে পড়েছে। হাঁটু দুটো বুকের কাছে তুলে তাদের উপর হাতদুটোকে আড়াআড়ি রেখে হাতের উপর থুতনি ভর দিয়ে বসল সে। জোলো হাওয়ায় চশমা ঝাপসা হয়ে যায় থেকে থেকে। পাঞ্জাবির খুঁটে মুছে নিতে হয়। এখন প্রয়োজন নেই। দেখার নেই সেরকম কিছু। পৃথিবীর ওই কোণে ক’টা লালচে মেঘ ঘাপটি মেরে আছে। ট্রলার কিম্বা জাহাজের আলো আলেয়ার মত দুলছে। নিরন্তর ঢেউ এর ঝাপটা। মাঝেমধ্যে খুব অল্প সময়ের জন্য পিছিয়ে যাওয়া স্রোত আর আগন্তুক ঢেউ এর মধ্যে একটা তফাত তৈরী হচ্ছে, কানে বড্ড আরাম দেয় সেই মুহূর্তের নিঃস্তব্ধতা। আরেকটু স্থায়ীত্বর জন্য আকুলিবিকুলি করে। তাহলে উঠে গেলেই হয়। উঁহু। এমনি শব্দহীনতায় হবে না। ওই ওইটুকুই চাই। একটু বেশি করে। অন্তু হাসে। ঢেউএর ঘ্যানঘ্যান ছাড়া ওই চুপ থাকাটুকুর কদর নেই। লাল মেঘের ঝুলি থেকে নিটোল চাঁদ বেরোল।

 

মাথাটা হিজিবিজি হয়ে রয়েছে। একটা চিরুনি পেলে চুলকে নিত। মাথার ভিতরটা কি চুলকানো যায়? হিজিবিজিটা  একটু গুছিয়ে দিলে কেউ, ভালো হত। সমাধান করে দিতে বলছে না অন্তু, শুধু সাজিয়ে দিতে বলছে নম্বর দিয়ে। এক। দুই। তিন। বাস্তবে ইয়ারফোনের থেকেও সাঙ্ঘাতিক জট। পেটে হিসি পাজামার নাড়ায় গিঁটের থেকেও কয়েক কাঠি উপরে। বালির উপর আঙুল চালায় অন্তু। আলতো সুড়সুড়ি নয়, ডট পেনের কালি শুকিয়ে গেলে  ঠোঙার গায়ে নিব ঘষার মত। ঢেঁকুরের মত রাগ উঠে আসে। এত রাগ কীসের? কার উপর? নাও, আরও দু’টো গিঁট। হাওয়া আছেই, থেকে থেকে এক’দুটো দমকা। ঝাউ এর ঝিরঝির বাড়ে তখন। “তুমসে মিলি যো জিন্দেগী, হমনে অভি খোয়ি নহি/ তেরে সিভা কোই না থা, তেরে সিভা কোই নেহি।” আঙুল থামে অন্তুর। রাগের মাথায় একধরণের কান্না পাওয়া যায়। সেই কান্নার দাম নেই বাজারে। কাউকে হারানোর কান্না দেদার বিকোয় হাটে। না পাওয়ার কান্নার বাজার ও চড়া। বেশ একটা আহারে উথলে ওঠে তাতে। লোকে ও’সব কেনে। কিন্তু ছেলের পরীক্ষায় দেরি হয়ে যাচ্ছে, এদিকে ট্রাফিক না সামলিয়ে গুটখা ডল-রত পুলিশের সাথে বেপরোয়া ঝগড়াটায় টুক করে মায়ের গলা ধরে গিয়ে যে কান্নাটা, উঁহু, কেউ কিনবে না। হাসবে দেখে। কিন্তু ওর দর উঠবে না। রগড়ের দামে হরির লুট হবে। সেরকমই একটা কান্না ঠেলে ফুঁড়ে উঠে আসছিল অন্তুর। শূন্যে বালি ছুঁড়ে মারল মুঠো করে।  তার বেশিটাই নিজের দিকে ফিরে আসল। দাঁতের ভিতর কিচকিচ। থুঃ। কান্নাটা বেরিয়েই এলো। কাঁদলে নাক বন্ধ হয়ে যায় অন্তুর। সর্দি সর্দি। নিজের কান্না শুনে নিজেকেই থাবড়াতে ইচ্ছে করে। পাঞ্জাবির খুঁটে চশমা মোছে, নাক ঝাড়ে। চাঁদটা ভিজে ভিজে লাগে। যেন সাদাটা তরল হয়ে এক্ষুণি চুঁইয়ে পড়বে সমুদ্রের উপর। বা পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। তাই বুক চিরে সাদা দাগ হয়ে রয়েছে কালো জলের উপর। এইভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকবে চাঁদ।

 

চাঁদের সাদাটা আঠালো। চটচটে। সারা গা জুড়ে অশুচি বোধ হয় অন্তুর। চুলকায়। মাথা চুলকায়। ছোটবেলায় বসন্ত হয়েছিল অন্তুর। শুকোনোর সময় মশারি দিয়ে ঘা চুলকোত। সেইরকম কিছু আঁতিপাতি করে খোঁজে অন্তু। সাপের মত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করে। বালিতে গড়াতে থাকে সে। লাভ হয় না। উঠে দৌড়য়। গোড়ালি ভেজে। হাঁটু। কোমর। গলা অব্ধি এসে থামে অন্তু। ঢেউ এর রাজ্য পিছনে ফেলে এসেছে সে। এখানে তাই ঢেউ এর শব্দ নেই। পায়ের কাছের জলটা ঠাণ্ডা। বুকের কাছটা গরম। কান জুড়িয়ে আসে অন্তুর। শরীর জিরোয়। জিভে, নাকে একটা নোনতা আরাম।

 

চাঁদটা একটা অতিকায় মেঘের পিছনে ঢুকে যায়। মেঘের বাটিতে চাঁদের সাদা জমে। ঝড়তি পড়তি যেটুকু, সেটা সমুদ্রের কালোয় গুলে যায়। দিগন্তের দিকে পিছন ফেরে অন্তু। মেছুয়াদের জাহাজের আলোর দিকে পিছন ফেরে।  গলা থেকে বুক। পায়ের পাতা। জুতোর ভিতর বালি কিচকিচ। বালি মাখা চটি হাতে ঝুলিয়ে, গায়ে লেপ্টানো পাঞ্জাবি নিয়ে অচঞ্চল পায়ে ফেরে অন্তু।

 

(৪)

 

সদাশিববাবু অফিস বেরোনর মুখে ভারী আশ্চর্য হলেন। গতকালও দিব্যি বেল্টের কাঁটাটা চার নম্বর ঘরেই ঢুকেছিল। বিগত তিন বছর তাই ঢুকে এসেছে। আজ ঢুকল না। চার অব্ধি পৌঁছচ্ছেই না! আয়নায় পাশ ঘুরে নিজেকে দেখলেন। কই, দৃশ্যত মোটা তো লাগছে না। একটু আমতা আমতা করে বউকে বউএরই বাঁধা প্রশ্নটা করলেন তিনি। “হ্যাঁ গো, আমায় মোটা লাগছে?” বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে সদাশিববাবুর স্ত্রী টিফিনবাক্সটা প্লাস্টিকে মুড়ে তার ব্যাগে ঢোকাতে লাগলেন। বড় মুশকিল। তিন নম্বরে নোঙর করলে ঢলঢল করবে। চার অবধি চলছে না। ছুঁচল অথচ শক্ত কিছু চাই, ফুটো করবার জন্য। কিন্তু এখন সময় নেই। বারান্দা থেকে সাদা অ্যাম্বাসাডর আর মিশ্রাজি কে দেখা যাচ্ছে। বারান্দার চেয়ারে বসে মোজা গলালেন সদাশিব। জুতোয় প্রবেশ করলেন। বৌয়ের বাড়িয়ে দেওয়া মুখ-বড় জলের বোতল থেকে জল গিলতে গিয়ে জামায় চলকালেন। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেল্টটা তিন নম্বরেই রাখা মনস্থির করলেন তিনি। গদাম করে সামনের বাঁ দিকের দরজাটা বন্ধ করে বললেন “চলিয়ে জী রামদেওরা।” বলেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। বারো মিনিটে এই দ্বিতীয়বার।

 

অফিসের গাড়ি। নেতাজীনগরের মোড় থেকে স্বপন চাটুজ্জ্যে উঠবেন বর্তমানটা চারভাঁজ করে। লেক গার্ডেন্স থেকে শেখর ছোঁড়াটা সিগারেটের পিছনটুকু পায়ে ডলে উঠে সেই যে মোবাইল নিয়ে খুটুর খুটুর করা শুরু করবে, চিংরিহাটার আগে থামবে না। ওইটুকুতেই ব্যাটারি ফুরিয়ে কোঁক কোঁক করবে যন্ত্রটা, তখন মুখ খুলবে সে। সহ্য হয় না। তাই সামনে বসা। মিশ্রাজী ও খুশি হন। ড্রাইভারের পাশে বসতে দ্বিধা নেই এই একজনের। পিছনে জায়গা থাকলেও সামনেই বসেন সবসময়।

 

মিশ্রাজীর সাদা অ্যাম্বাসাডর রামদেওরা যাবে না। সিআইটি রোড হয়ে শেয়ালদা পাশ কাটিয়ে বেলেঘাটা যাবে। ঢাকুরিয়া ব্রিজ থেকে থমকে থমকে নামবে। বালিগঞ্জের সিগনালে মিশ্রাজী চাবি খুলে নিয়ে এক প্যাকেট গুটখা না খৈনী কীসব নিয়ে আসবেন। চেষ্টাচরিত্তির করলে রাণাঘাট কি ডায়মন্ড হারবার অবধি যাওয়া যায়, মিশ্রাজীকে দু’টো নোট ধরিয়ে দিলে। কিন্তু তিব্বত কিম্বা রামদেওরা অসম্ভব। এক ছেলের বাবা চুয়ান্ন বছরের সদাশিব গাঙ্গুলির আঠেরোই কার্তিক মনে হল তাঁর রামদেওরা যাওয়া উচিৎ। এক্ষুণি। অবিলম্বে। তারপর তিব্বত। তারপর কৈলাস। তারপর পামীর। হিন্দুকুশ আর কারাকোরামের পামীর। পামীর দেখা হয়নি সদাশিববাবুর। নিজের ছাদে দাঁড়িয়ে সাহাদের ছাদকে টপকে যেতে দেখেছেন, পৃথিবীর ছাদ টপকানো হয়নি। পামীর। জুরা, কুচাকের পামীর। দুরন্ত ঈগলের পামীর।

 

গোলপার্কের জ্যামেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে পড়লেন সদাশিববাবু। পিছনে দড়াম করে মিশ্রাজীকে চমকিয়ে দিয়ে নিজের জীবনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। যা কিছু পরিচিত। যা কিছু পুরোনো। যা কিছু হয়েছে। জবাবদিহির দায় আছে, কিন্তু নেবেন না। হঠকারী সিদ্ধান্ত। জানেন। ভীষণ রকম স্বার্থপর। আর মানে ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি, প্র্যাক্টিকালিটি বলে একটা জিনিস নেই? আছে, জানেন। জানেন এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট লাইন দিয়ে তৎকালে যোধপুরের টিকিট কেটে থ্রি এসিতে ওঠার পরে আর নিজের নামটাও হয়ত মনে থাকবে না। অপরাধবোধ সুরক্ষাহীন লেভেল ক্রসিং পেরোতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়বে।

 

ছাইরঙা রুমালটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দু’টো দুহাজারের নোট বাড়িয়ে দিলেন সদাশিব গাঙ্গুলি। ওয়ান ওয়ে। সব বেরোনোর ফেরা হয় না।