ঢাকুরিয়া ব্রিজের ঢাল বেয়ে গড়গড়িয়ে নামে বাসটা। উৎসুক মুখগুলো হাত বাড়িয়ে থামায়। “এইট বি?” যাবে না। যাবে না। নিরাশ, ক্লান্ত হাতগুলো নেমে আসে। আরেকটা দিন ফুরোতে চলল। টেনে লম্বা করার হাল্কা প্রয়াস। “আমায় পৌঁছে দিবি না?”

সমস্ত কাব্য-গদ্য অনুযায়ী তার চোখের দিকে তাকালে সময় থেমে যাওয়া উচিৎ। বাস্তবে হুহু করে খোলা সিগনাল পেরোতে থাকে। কন্ডাকটারটারও বিশেষ চার নেই আজ। বড্ড বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা হয়ে গেছে। “নাহ। ছাড়, তোর দেরি হয়ে হয়ে যাবে।” সমঝদারির ছাড় নয়। অভিমানের ছাড়। ভীষণ স্পষ্ট “হোক দেরি, ওইটুকু তো রাস্তা বাসস্টপ থেকে।” প্রবল তীব্রতায় ঠোঁট চেপা। নাকের পাটা ফোলা। কান লাল। বাসেই কাঁদবে নাকি? উফ। তোলপাড়। তোলপাড়। “নামতে কি আমার মন চায় না” টা চীনের প্রাচীরে আধলার থেকে বেশি কাজ করবে না। ধুর। নেমেই যাই।

যেতও। যদি সম্ভব হত। সত্যি ই। একটা ওয়ান ফাইন মর্নিং এর কনুই ধরা “আর কিছুক্ষণ প্লিজ” ফাউ পাওয়া যেত। কিন্তু উপায় নেই। নেই। থাকলে বলতে হত না একবারও। একটা নীরব নেমে যাওয়া চাক্ষুস করতে হত না। “আসছি” টা একটু পিছোত। এগারো মিনিট। খুব বেশি হলে চারটে শব্দ উচ্চারিত হত। তবু। পিছোত। অনাকাঙ্খিতকে যতটুকু দূরে ঠেলা যায়। অবশ্যম্ভাবীকে যতখানি রোধ করা যায়। কিন্তু। উপায় নেই। এইসময়টুকু খুব কঠিন। বেছে নেওয়া। ভারসাম্য। খুব কঠিন।

থানার মোড়ে লালবাতি জ্বললে কাজটা আরো কঠিন হত। জ্বলল না। গতি না কমিয়েই ডাইনে মোড় নিল বাসটা। অন্তরীক্ষ এই প্রথম বাসটার ভিতরে দেখল। আর কেউ নেই এখন। আলো নিভিয়ে দিয়েছে। অন্তরীক্ষকে অবাক করে দরজা ছেড়ে তার সামনে সিটে এসে বসল চোয়াড়ে গাল-ওলা কন্ডাকটর। আঙুলের ফাঁকের নোট গুলো চালান করল কাঁধের ব্যাগে। হাঁটু চুলকালো। হাত বাড়িয়ে বলল “মাইসেলফ ছোটন”। অন্তরীক্ষ ভ্যাবলার মত হাত নাড়িয়ে বলল “অন্ত- ফটিক।”
বিজ্ঞপনা শুরু করল ছোটন। “নেমে গেলে পারতে।” চোখ ছোট করল ফটিক।

“নেমে গেলে পারতে, তাই বলচি। কিচু মনে কোরো না, পুরো-” ফটিক ভুরু কোঁচকালো।

“কাজ ফাজ করা হয়?” ফটিক উপর নীচে মাথা নাড়ে।
“টিকবে না।” ফটিক ঘোঁত করে একটা আওয়াজ ছাড়ে।
“টিকবে না। বেকারদের ছাড়া প্রেম টেকে না। এই দেখো আমায়। বেকার ছিলাম। ওর বাপ বিয়ে দিতে চাইল না। কন্ডাকটরি শুরু করলাম। ভোর থেকে রাত। একদিন ফিরে-” কাঁদো কাঁদো কন্ডাকটর কখনও দেখেনি ফটিক। কাঁধে হাত রাখে। “অন্যজন বেকার?” ফুঁসে ওঠে ছোটন। “বেকার বলে বেকার?” জামার হাতায় চোখ মোছে ছোটন। বাম্পারের ঝাঁকানিতে খুচরো ঝনঝনিয়ে ওঠে। গলা খাঁকারি দেয়। “নেমে গেলে পারতে।”

কাঁচে মাথা রেখে গলফগ্রীন পেরিয়ে যেতে দেখে ফটিক। আর কিছুক্ষণগুলো তাড়া করে বেড়ায়। “নামো, নামো। বাড়ি যাবো।” বিজয়গড়। পাদানিতে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে টেপাটেপি শুরু করে ফটিক।

“কাল থেকে আমি বেকার, হুঁ?”

রাণীকুঠি নাগাদ উত্তর আসে।

“কীহ?”