বম্বে মেলের মতন যখন উদ্ধত তুই,

দৃকপাতহীন অনায়াসে পেরোস আমায়,

ঝোরার উপর লোহার সেতুর অনুরণন,

কার সাধ্য বুকের প্রতিধ্বনি থামায়?

 

পাথরকুচির উপর দিয়ে হাঁটতে পায়ে লাগে। লাইনের উপর ভারসাম্য রাখা যায় না। চার পা। সাত পা। বারো পায়ের বেশি না। দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয় রঘু। এমনি হাঁটা। কোথাও যাবার জন্য নয়। কোথাও থেকে পালাবার নেই। হাঁটতে ভালো লাগে বলে হাঁটা। জোড়া লাইনের মাঝের সারি সারি চ্যাপ্টা কাঠগুলোয় পা ফেলে ফেলে এগোয়। মাঝেমধ্যে পিছন ফেরে, ট্রেন আসছে কিনা দেখবার জন্য। কান খাড়া রাখে। মুচকি হাসে রঘু।

প্রথম দেখাটা আচমকা ছিল না। আলাপটা প্রথম দেখার জন্য হাপিত্যেস করে বসে ছিল না। আলাপ হয়েছিল পূর্বরাগে। অন্য কালে, স্থানে, মাত্রায়। মন্দ লয়ে। দ্রুত হবার প্রতিশ্রুতিতে প্রথম দেখা। বহুকল্পিত, কিন্তু পরিকল্পিত নয়। রঘু পায়ে পায়ে বাড়ি ঠিক ই খুঁজে নিয়েছিল। জানান দিয়েছিল, এসেছি।

পাথরকুচি শেষ হয়। রঘু লাইনের বাইরে বেরিয়ে আসে। কাঠের পাটাতনগুলোর মাঝে মাঝে ফাঁক। নীচে তাকালে ঘোলাটে সবুজ জল দেখা যায়। রঘু ইস্পাতের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। ছোট্ট সেতু, সোরাব নদীর উপর। নদীতে চরা পড়েছে। বছর দুয়েক আগে সঙ্গমে গিয়েছিল রঘু। সোরাব যেখানে ভারসাই এ মিশেছে। ভারসাই আরো দক্ষিণে বইলে সালেমপুরের বন্দর। সেইখানে দিগন্তজোড়া সেতু রয়েছে একখানা। শুনেছে রঘু দেখেনি। ছোট্ট মফস্বলি চোখে সোরাব ই তার নাড়ী। ঠিক মাঝখানটায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। মস্তবড় ইঁটের পিলার কাঁধে করে ধরে রেখেছে সেতুটাকে। আর চরের বুকে সেই খুঁটি। হাজারটা গরুর পায়ের ছাপ। আর একটা প্রাগৈতিহাসিক মালগাড়ির কোচ, জীবাশ্ম হয়ে শুয়ে।

রঘু মোড়ের একক রিকশাটার পিছনে দাঁড়িয়ে জানান দিয়েছিল, এসেছি। বুদবুদ জমছিল। “আসছি। আসছি।” উত্তর এসেছিল। “কিন্তু কেউ দেখে ফেললে?” সব সমস্যার সহজ সমাধান। না চেনার ভান। গেট খুলতে দেখল রঘু। অধীর গলার “আরে, বলছি তো তাড়াতাড়ি ফিরব” শুনল। শুনল কোনও মেকি অজুহাত। একজোড়া খিলখিল নামল রাস্তায়। একজোড়া, একখানা বান্ধবী সমেত। বডিগার্ড? অপ্রস্তুতি সামলানোর ঢাল? দু’ জোড়া আড়চোখের সতর্ক সন্ধান। কই? কই টা বেরোল রিকশার পিছন থেকে। অর্ফিয়ুসের থেকেও কষ্ট ঘাড় না ফেরানো। ক্যাবলা হাসির দমক চাপা। অপ্রতিভতা আড়াল করা। রাধাচূড়ায় জটায়ুর বাসা খুঁজতে খুঁজতে পেরিয়ে গেল তারা। মাথা চুলকে যেন নিতান্তই কাকতালীয় অনুসরণ।

“সেদিন এত বুলি কোথায় ছিল?” সোরাবের বুকে চর। চরের পিঠে খুঁটি। খুঁটির কাঁধে সেতু। সেতুর মাঝে রঘুকে জিজ্ঞেস করল সে। ঠোঁট কামড়ে। রঘুর উত্তেজিত ব্যাখ্যা থেমে গেল। “কেমন করছিল…” “কেমন?” পাতাল অবধি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা হুইসল। দুই বার। তিন বার। চারবারের মাঝামাঝি হুড়মুড়িয়ে ব্রিজে উঠে পড়ল ট্রেনটা। চাকায় কাহারবার বোল। রঘুর কানের ভীষণ কাছে মুখ নিয়ে এসে ফের জানতে চাইল সে। “কেমন?” তার হাত নিয়ে অসীম কম্পাঙ্কে শিউরাতে থাকা সেতুর ইস্পাতের পোলে ঠেকালো রঘু।

“এমন।”