রোদ টা নামতে নামতে এখন হাঁটুর নীচে। খালি পা’দুটো গরম হচ্ছে। আস্তে আস্তে। ওমে, আঁচে। তেতে পুড়ে যাচ্ছে না মোটেই, বরঞ্চ শীতটা লাগছে না আর। আরাম হচ্ছে। বারান্দা থেকে ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায় আজকাল। গরমকালে সেটা হয় না, কাস্টমস আপিসের পিছনে সাততাড়াতাড়ি সূর্য টা চলে যায়, কমলা রঙ টুকুও ধরে না। শীতকালে আপিসের ছাদ সূর্য পাড়তে পাড়তে সেটা বেশ পেকে যায়। তার আগে প্রীতমের পা গুলো সেঁকে দিয়ে যায় খানিক। 
 
বারান্দার নীচে অসমান পিচের রাস্তা, ওইপারে বেশ কয়েকটা ডালিম গাছ। ডালিম আর বেদানাতে পার্থক্য কী? বেদানা নামটা খারাপ। ডালিম বড় রূপকথাময়। চাদর জড়িয়ে ডালিমকুমার টিয়ার ঝাঁকের অপেক্ষা করে। পাপ্পুদের বাড়ির কুকুরটা চেঁচাচ্ছে। আজান শুরু হব হব। শীত বিকেলের উপর মন খারাপের সর। নাক ঠোঁটের উপর ক’টা মাছি ভনভন করছে। সরানোর শক্তি নেই প্রীতমের। বুকের বাঁদিক করে একটা গভীর ক্ষত তার। 
 
প্রীতম টের পাচ্ছিল সে মরে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাইরে রক্ত নেই তেমন, কিন্তু ছুরির ফলাটা ফুসফুস ভেদ করে দিয়েছে বোধহয়, হাওয়ার থলে থকথকে তরলে ভরে উঠছে, উঠে আসছে নিঃশ্বাসের সাথে। কষে গরম কিছু গড়িয়ে যাওয়া টের পায় প্রীতম। 
 
ব্যথা সেরকম নেই। সমস্ত সীমার উর্ধ্বে উঠে গেলে সব সয়ে যায়, অবশ হয়ে যায় দেহ। পরীক্ষার একমাস আগে থাকতে তার ক্রিকেট পরবর্তী লুকোচুরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হত। আলো কমতে থাকলে ল্যাম্পপোস্টের ফ্লাডলাইট, তাও ঢিমে হতে থাকলে বল হারিয়ে যাবার ভয় ইতি। তখন লুকোচুরি। সেটাই সবথেকে উপভোগ্য লাগত প্রীতমের। মাথার উপর ভনভনে একগুচ্ছ মশার আড়ত দেখে কে কোথায় লুকিয়েছে চিনতে শিখেছে সে। এ কায়দার পেটেন্ট তার। কিন্তু ম্যাচ শেষের পর যখন বল পকেটে ফিরতে হত বাড়ি, তখন বড় অবসন্ন লাগত। ডালিমের নীচে চোখ চেপে কুড়ি গুনত গুঞ্জন, মুলোর তরকারি দিয়ে রুটি খেত প্রীতম। খানিক সেইরকম অবসাদ হচ্ছে তার। খেলা হবে না। আর কোনোদিন না। 
 
বারান্দার চটের ঝুড়ির দোলনাটায় এলিয়ে পড়ে থাকে প্রীতম। ডালিমফুল দেখলে হঠাৎ করে জবা বলে ভুল হয়। হাঁটু ছড়ে গেলে ডালিমফুল কুড়িয়ে ঘষে নিত। রক্ত তুরন্ত বন্ধ। প্রীতম বড় করে চোখ খোলে। টিয়াগুলো আসা শুরু করেছে। দড়ি দিয়ে বেল্ট পরা আলগোজাওলা এসেছে আজ আবার। তিরিশটাকা দাম একেকটার। জমেনি এখনও। জমবে না। দুইখানা বাঁশি একসাথে মুখে পুরে বীনের মত কাঁপা কাঁপা না-মেঠো-না-পাহাড়ি কোথাকার যেন একটা সুর বাজায় সে। চোখ বোঁজে প্রীতম। একটা বড় খোলা সবুজ মাঠ। মধ্যিখানে একটা ডালিম গাছ। তার তলায় সে কালোর উপর রঙচঙে তাপ্পি দেওয়া আলখাল্লা পরে আলগোজা বাজাচ্ছে। ঠিক বাবু হয়ে বসে নয়। বাবু হয়ে তো আড়বাঁশি বাজায়। সাপুড়েদের মত করে বসে। ছোট্ট একটু সুর, এক দুটো লাইন। শেষেরদিকটা চড়ায় উঠতে উঠতে ঝুপ করে খাদে নেমে শুরু থেকে শুরু হবে আবার। ঘুরে ঘুরে বাজবে। 
 
ডালিমের মতন লাল হয়ে গেছে সূর্যটা। ওর লুকোনোর জায়গা একটাই। সূর্য্য কে হুশ দেওয়া খুব সোজা। প্রীতম হাসে।