মায়ের গায়ে ঠাকুর ঠাকুর গন্ধ। 
 
এক মনে খালি স্টিলের গ্লাস হাতে নিয়ে নারকেল ছাড়ানো দেখছিল বুকু। শাজাহান মরচে ধরা কালো দা টা এক কোপে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল নারকেলের পেটে, এক মোচড়ে আলগা হয়ে উঠে আসছিল ছোবড়া। খয়েরি পেশিবহুল হাতে সেটা উপড়ে আনছিল শাজাহান। পায়ের কাছে এত্ত ছোবড়া জমা হল। দাড়ি কামানোর মত করে নারকেলটাকে মসৃণ করে তুলল সে। বুকু ধৈর্যশীল। অথবা সে শুধু শেষেরটুকুর জন্য দাঁড়িয়ে নেই। এই গোটা একাঙ্ক নাটকটারই টিকিট সে কেটেছে। শাজাহান এক কোপে আধখানা করে ফেলল নারকেলটা। একটু ছোট বড় হয়নি, এবড়োখেবড়ো হয়নি ধারটুকু। গ্লাস বাড়িয়ে ধরল বুকু। অল্প কটা ছোবড়ার টুকরো ভাসা নারকেলের জল। এমন পাথরের বুক থেকে বেরোয় বলেই হয়ত ঝরনার থেকেও দামী। বুকু, এক চুমুকে চোঁ করে খেয়ে ফেল তো দেখি? 
 
সন্ধ্যে হবার মুখে বাবার সাথে বেরোয় বুকু। গোলাপি আকাশ। বাবা তো মানিব্যাগ নেয় না, ফতুয়ার পকেটে খুচরো ঝনঝন করে। বুকু মনমরা, বাবার সাইকেল সুকুর দোকানে। এই তেকোনাটায় পা দিয়ে রাখো বুকু, রিকশা ব্রেক কষলেও হুমড়ি খাবে না তাহলে। ব্রিজে ওঠার মুখে বাবা নেমে যায়। চড়াই। বাবা সাইকেলে ওঠে পা পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে, রিকশাকাকু তার বাহন চাপে সামনে দিয়ে পা উঁচিয়ে। সেভাবেই নেমে হাতে করে টেনে তোলে রিকশা, বুকু একলা বসে থাকে। দশকর্মার দোকানে ভিড়। কিন্তু হাল্কা। এক গুচ্ছ কোমর পেরিয়ে বুকুর মাথা সামনের শিশির সারিতে আটকায়, পা উঁচিয়ে ওপারে নজর চালায় বুকু। গন্ধক। কর্পূর। চন্দন। ধূপকাঠি। বুকু, ধরো না কিছু, কাকু রেগে যাবে। গন্ধ ছোঁয়া যায়না, বাবা জানে না? বাড়ি ফিরে কর্পূরের টুকরো মিশতে দেখে বুকু, টুকরো নারকেলের ছোবড়ায়। মা কোমরে শাড়ি গুঁজে ধুনো নিয়ে বেরোয়। বুকু কর্মকার জুয়েলার্সের লাল গয়নার মখমলি পার্সে রাখা তার সম্পদ গুনতে বসে। আর তিন টাকা হলে বড় ক্যাপের রোল। মা খাটের উপর পাজামা পাঞ্জাবি রেখে দিয়েছে। হলুদ পাঞ্জাবির পকেট উঁচু হয়ে আছে। বুকু চিনতে পারে। লাগবে না তিন টাকা আর। এক গাল হাসি মেখে বুকু দৌড়োয়, মা, পাজামার দড়িটা বেঁধে দেবে না? 
 
পাশবালিশ জড়িয়ে মশারির ভিতর শুয়ে সন্ধ্যের জাবর কাটে বুকু। পাজামায় সসের দাগ লেগেছে। ও কিছু হবে না। তিন বাণ্ডিল ক্যাপ বেঁচে। আর এক প্রস্থ যুদ্ধ হয়ে যাবে কাল ওতে। চোখ জুড়িয়ে আসে বুকুর। ঢাক থামল বুঝি? অনেক রাত? মা ঘরে ঢুকেছে, বুকু টের পেল। গন্ধে। ধুনোর গন্ধ শাড়িতে, গায়ে নিয়ে মা পাশে এসে শোবে। পাশবালিশ লাগবে না বুকুর আর। মায়ের গায়ে ঠাকুর ঠাকুর গন্ধ এখন।