দুপুরবেলার আড়াই ঘন্টার ঘুমে বাকরখানির স্বপ্ন দেখল তিমির। চোখ কচলে সেটাই মনে করার চেষ্টা করছিল সে। খাপছাড়া কিছু দৃশ্য উদয় হচ্ছে কেবল। সন্ধেটা এই করেই গেল। বারকয়েক “এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন?” জিজ্ঞেস করে গেল সুজাতা দিদি। সোফার কনুইদানিতে মাথা রেখে “কই, না তো!” বলে গিয়েছে তিমির। স্বপ্নটা মনে করা জরুরী।
একটা গ্রাম। গ্রামের নাম ঝিকরগাছি। বারাসাত-বারুইপুরের যে বাসগুলো গড়িয়া মোড়ে আকছার দেখে তিমির, সেইরকম একটা বাস যায় ঝিকরগাছি। ঝিকরগাছির হাট। বেশ খানিক খোলা জমজমাট জায়গা। এক কোণে একটা অমলতাস গাছ। তার সোনালি ঝুরির তলায় দাঁড়িয়ে তিমির হাট দেখছে। তিমির কে দেখতে পাচ্ছে না কেউ। খুব সাধারণ সামগ্রী বিকিকিনি হচ্ছে হাটে। রঙচটা পটল। রাঙা আলু। পেয়ারাগুলো বড্ড ভালো। ছিবড়ে ডাঁসাও নয়, গলা মোমের মত নরম ও নয়। ঠিক সে যেমনটি চায়। স্বপ্ন তো। বনগাঁ লোকালে নিউ ব্যারাকপুর থেকে এরকম স্বপ্ন-সত্যি-পেয়ারাওলা উঠেছিল। বিটনুনের প্রলেপ দিয়ে… স্বপ্নটা কি আদতে পেয়ারার স্বপ্ন?
সপ্তাহে এই একটা দিন-ই নিজেকে রেঁধে বেড়ে খেতে হয় না। পরবাসে বড় জ্বালা। ভাজা পেঁয়াজে আদাবাটা পড়ল। সুজাতা দিদি কাঠের খুন্তি নাড়ছে আর বকে চলেছে সমানে। একে একে জিরে, হলুদগুঁড়ো। পিলে চমকানো হাঁচি। খোল, খোল, উঠে দরজাটা খুলে দে। দরজা খুলে বিস্মিত হয় তিমির। বৃষ্টি নামল কখন? ভ্যানিলার গন্ধ। পা ভিজছে। ও কী করছে? ভোর হয়নি, পিছন উল্টে ঘুমোচ্ছে এখনও। ভ্যানিলা আচ্ছন্ন করে রাখে। দরজা খোলা রেখেই ভিতরে ঢোকে সে আবার। ভিতরটা গরম। ধোঁয়া। লঙ্কাবাটা পড়ল। মশলা এসেছে আটলান্টার ভারতীয় বাজার থেকে। যেতে আসতে চার ঘন্টা। ভিজে ধনেপাতা কুচি করছে সুজাতাদিদি। ধনেপাতা পড়লে কেমন শীতকাল শীতকাল খেতে হয়ে যায় সবকিছু।
হ্যাঁ। হাল্কা ঠাণ্ডা ছিল ঝিকরগাছিতে। পায়ে পায়ে ভিড় মাপছিল তিমির। একটা দু’টো জটলা, তার বেশি নয়। তখনই মুড়িওলার কাছে বাকরখানি দেখতে পেয়েছিল তিমির। মুড়িওলা তাকে দেখতে পায়নি। তাই কেনা হয়নি। খাওয়া হয়নি। শুকনো তেজপাতা। ঠাকুমা বলত চেটে খেলে বউ ফরসা হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে চাটত ছোট্ট তিমির। মা, ঠাম্মার সামনে ইচ্ছে টা ফাঁস হয়ে গেলে চূড়ান্ত লজ্জা, কিন্তু ফরসা বউয়ের শখ ছিল ষোলআনা। তখনো বর্ণ বা লিঙ্গবৈষম্যের পোকা মাথায় ঢোকেনি। ও অবশ্য… গোটা সর্ষে। একটুখানি জল দিয়ে শিল নোড়ায় বাটত মা। পোস্তও। নোড়ার ঘষা দিকটা কেমন মসৃণ হয়ে থাকত। বাড়ির পিছনে কারিপাতার গাছ ছিল। করমচা’র মত ক্ষুদে ক্ষুদে ফল হত। নিমের মত পাতা। ঝাল সুজিতে দিত মা। ঘাড়ে শীতের রোদ টের পাচ্ছিল তিমির।
আলগা ভাতে পেঁয়াজ আর রাধুনী ফোড়ন দেওয়া মুসুর ডাল ঢালে তিমির। গরম। পাশে একটা গন্ধরাজের টুকরো রেখে দেয় সুজাতাদিদি। তিমির অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বেনি। বেঞ্জামিন। বেণীমাধব। বেনি তাকে টালাসির হাটে নিয়ে গিয়েছিল। ফ্লি মার্কেট। রেড ইন্ডিয়ান পুতুল। বাগান করার যন্ত্র। কমলা রঙের পোশাক। পুঁতির গয়না। ঘর সাজানোর কত্তকিছু। একটা বিশ-হাতি আয়না। গোলাপি ফতুয়ার মত কী একটা জামা আর হাফ প্যান্ট পরা পক্ককেশ লোলচর্ম বুড়ির থেকে বরফ ঢালা লেমনেড কিনেছিল তিমির। চোখ বুঁজে এসেছিল আরামে। বেনি পিছন থেকে ডেকে বলেছিল, রোজমেরি ব্রেড খেয়েছ? তিমির রোজমেরি ব্রেড খায়নি।
হাট ঘুরে অমলতাসের তলায় এসে বসে তিমির। ঘাসের শিস চিবোয়। পুদিনার মত স্বাদ আসে। ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। স্বপ্নের মধ্যেও ঘুম? বাহ। হাট শেষের তোড়জোরে তার ঘুম ভাঙে। মেয়েটাকে দেখতে পায় তখন। একেবারেই আশ্চর্যের নয় যে মুখটা তার, যে এখনও ঘুমোচ্ছে। আশ্চর্যের এই, যে মেয়েটা তাকে চিনতে পারছে না। এই হয়। মেয়েটার ঝুড়িতে কী? ও মেয়ে? মুখ তুলে তাকায় সে। আর কেউ পায়নি দেখতে, মেয়েটা পেয়েছে। এগিয়ে এসেছে পায়ে পায়ে। কি জানি কী নাম তার, এই ঝিকরগাছিতে… “কী বেচ?” জানতে চেয়েছে তিমির। চা পাতা, সে উত্তর দিয়েছে। “অনেক রকম চা পাতা, তুমি নেবে?” স্বপ্নের মধ্যেও ভারী বিপদে পড়ল তিমির। পয়সা নেই যে। “আমায় একটা জামা বুনে দিও তবে?” মেয়েটা বলেছিল। “তাতে সেলাই থাকলে চলবে না কিন্তু!”
তিমির সেদিন রোজমেরি ব্রেড খেয়েছিল। কটা চোখের একটা মেয়ে বানাচ্ছিল সে সুবাসিত রুটি। তক্ষুণি তক্ষুণি সেঁকে তুলে দিচ্ছিল পাতে। রোজমেরির গন্ধ শুষে নিচ্ছিল তিমির। মেয়েটাকে রোজমেরি বলে ডাকতে সাধ হচ্ছিল। তিমির খেয়াল করল, এক কাপড়ের জামা পরে রয়েছে রোজমেরি। সেলাইহীন। সিমলেস। হাতে বোনা। হাঁটুর আগেই শেষ। “আরও অনেক রকম রুটি বানাতে পারি আমি” চটক ভেঙেছিল তিমিরের। হেসেছিল। “পার্সলে,সেজ, রোজমেরি আর থাইম।” রোজমেরির মুখটা ক্রমশ…
“খুব অন্যমনস্ক তুই আজ। খাচ্ছিস ই না।” সুজাতাদিদি বকে।