মিহির কে পুঁতে ফেলার দিন বৃষ্টি নেমেছিল। চোদ্দ দিনের মাথায় সে বৃষ্টি থামল।

এই চোদ্দদিন একপ্রকার ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে তাকে টং এর ঘরে। থাকতে হয়েছে বলা ভুল। থেকেছে। শোকপালন? সে নিজেও জানেনা। জানালাগুলো দিয়ে হুহু করে পশ্চিমি হাওয়া ঢোকে। বন্ধ করার পরেও। পাখা চালাতে হয় না। নোনা হাওয়া। জোলো হাওয়া। ওদিকটা সমুদ্র যে। সমুদ্রটা মোটে পছন্দ না তার। ঘোলা জল। পায়ের কাছে আবর্জনা সমর্পণ করে। এক সময় রোজ যেত। নিত্যদিন। চশমা ঝাপসা হয়ে যেত মিহি ছিটেয়। জামায় মুছতে হত মুহূর্মুহ। এক পা বালি নিয়ে ফিরত তারপর। সে বালি তাড়া করত তাকে রাত্রিদিন। চুলের জটে, হাঁটু অবধি তোলা সালোয়ারে, গামছায়, পাপোষে, বালিশের ওয়াড়ে, পর্দার গায়ে, ভুরুতে, কেচে শুকোতে দেওয়া নীল কামিজটায়, নারকেল তেলের শিশির ঢাকনায়, পাঁচফোড়নের কৌটে। গায়ে দেবার ছাই ছাই চাদরটা ঝাড়ার সময় কিছু ঝরে পড়ল একবার। একদিন সকালে মুখের ভিতর বালি টের পেল সে। তারপর থেকে ছাদ থেকেই নোংরা ফেনার ঢেউ দেখত শ্রী। ছাদ থেকে গোটা গ্রামটা দেখা যেত, অনেক উঁচু থেকে, হাঁটুর উপর সাদা লুঙ্গি তোলা খয়েরি মানুষগুলো দিশেহারা পিঁপড়ের ব্যস্ততায় নড়ে। ছাদ থেকে পূবদিকে মালাই পাহাড়ের সারি দেখতে পেত সে। নারকেল গাছের মুণ্ডগুলো মাকড়সার জালের মত কুয়াশা ভেদ করে জেগে থাকত। আর থাকত বিদ্যুৎ কারখানার অবিরাম চিমনিগুলো। মেঘগুলো পায়চারি করত তার উঠোন দিয়ে। মনে মনে কল্পনা করত শ্রী। এক দঙ্গল সন্ত্রস্ত কয়লা মাখা শ্রমিক নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে। কী ভয়ানক রহস্য যেন লুকোনো সে কারখানার ভিতর। কী তৈরী হচ্ছে কেউ জানে না। এক জোড়া অদৃশ্য চোখ নজর রাখছে সবসময়। মাঝেমাঝে মনে হয় সৈন্য পোষা আছে ভিতরে। বা সৈন্যই তৈরী হচ্ছে। তাদের ইস্পাতের অস্ত্র, লোহার বর্ম। তাদের কদাকার মুখে যুদ্ধের ক্ষত। তারা কেবল হুকুম তামিল করতে জানে। ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠত শ্রী। ভাবতে ভালো লাগে।

এই চোদ্দ দিন ছাদে যাওয়া হয়নি। সোঁদা তোষকে স্থাণু হয়ে থেকেছে। চেনা মুখ এসেছে কিছু। থেকেছে। থাকছে। কারুর মধ্যে বিষণ্ণতা টের পায়নি শ্রী, উল্লাস ও না। কথা হয়েছে বিস্তর। শ্রী ও মুখ বুঁজে থাকেনি। হাওয়া ঘরে দেশলাই জ্বালিয়েছে কায়দা করে। সুকিয়াতে বেশি দিন নেই আর। তামাকপাতা আর অবশিষ্ট গাঁজাপাতা গুঁড়ো করে কাগজে পাকিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে। বুক ভরে সে ধোঁয়া নিয়েছে শ্রী। নিয়েছে অন্যরা। ঝড়টুকু জানালার বাইরেই থেকে গেছে, বৃষ্টি বেখেয়ালে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। সোঁদা তোষকে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়েছে সে। মিহিরের কথা ভেবেছে। মিহির। মাটির তিনফুট নীচে। কফিনহীন, চাদরে মোড়া তার শরীর। চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে শ্রী। ঘরভর্তি লোক আবছা হয়ে গেছে, শরীরে মিহিরের উত্তাপ পেয়েছে শ্রী।

কখনও ক্ষিদে পেয়েছে। শরীরে মন্থন হয়েছে তার, খালি কৌটোর তলানি থেকে এক আঙুল বিস্কুটের গুঁড়ো মুখে পুরেছে। কলাপাতায় খিচুরি এনে দিয়েছে কেউ কখনও। শেষ কড়াইশুঁটি টাও খুঁটে খেয়েছে সে। প্রতিদানে আবডালে বাহককে তার বুকে হাত দিতে দিয়েছে। কিছু যায় আসে না আর। আঙুলগুলো তার বৃন্ত ছুঁচ্ছিল যখন, তৃপ্তি ভরে নিজের আঙুল চাটছিল সে। তারপর বোতাম আটকে হাত ধুয়ে ফিরে এসেছিল ঘরে। সেই বাহকের হাত ঘুরেই গর্ভবতী সিগারেট ফেরত এসেছিল তার কাছে।

চোদ্দ দিনের দিন সকালে বৃষ্টি থামল। থমথমে অস্বস্তি বাস করছিল ঘরে। দুই সপ্তাহের বৃষ্টি থামার নৈঃশব্দ সইয়ে নিতে সময় লাগে। শ্রী উঠে জানালা খুলে দিয়েছিল। হাওয়ার তেজ ও কমেছে। শ্রী খোঁপা খুলল। শ্রী জামা সরিয়ে রাখল। শ্রী তার ঘরময় ছড়ানো অর্ধচেতন চোখের সামনে অনাবৃত হল। দরজা খুলে ভিজে সিঁড়ি বেয়ে উঠল ছাদে। পায়ের পাতা থেকে একটা ভিজে ঠাণ্ডা তার নগ্ন শরীর বেয়ে উঠে কান, নাক বেয়ে মাথায় উঠল। ভিজে পাঁচিলে শরীর এলিয়ে নীচে তাকাল শ্রী।

মিহিরের শরীর জল পেয়েছে বিস্তর। তার চোখের পাতার উপর আলগা মাটি জমাট বেঁধেছে। তার ফ্যাকাশে রক্তশূন্য দেহ চুঁইয়ে মিশেছে মাটিতে। তার কঠিন হাড়ে শিকর গজিয়েছে। মিহিরের দেহের উপর একটা গাছ জন্মেছে চোদ্দ দিনে। চোদ্দ দিনে সে গাছ শ্রী এর মাথা ছাড়িয়ে গিয়েছে। পরিত্যক্তমান গ্রামের অবশিষ্ট মানুষ একটা উলঙ্গ মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখেছে কিছু আগে। এখন সে সেই গাছের তলায়। নজর দেবার সময় কারুর নেই। গ্রাম ছাড়তে হবে। অবাক হবার সময় কারুর নেই। গ্রাম ছাড়তে হবে।

গাছটাকে জড়িয়ে ধরে শ্রী। বুক ভরে শ্বাস নেয়। ছাতিম। ছাতিম।