বাবুরাম কেটে পড়ার তালে ছিল। পা টিপে টিপে খিড়কী দিয়ে বেরিয়ে উঠোনপানে এগোচ্ছিল সাবধানে। কিন্তু বাবুরামের কপাল লেখার সময় বিধাতা সরকারের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছিল। তাই সে ধরা পড়ে গেল দুর্জয় বাহাদুরের কাছে। দুর্জয় তেতলার বারান্দা থেকে চিল্লালেন, “ও বাবুরাম? বলি কোথা যাস?” বাবুরাম আখ ছুলতে পারে দাঁতে, নিমের ডাল নিয়ে দাঁতন করে সকাল বিকেল, তাই জন্য ঐরকম রাক্ষসীয় দাঁত কিড়মিড়ের পরেও সেগুলি টমের মত খসে পড়ল না। মাথা তুলে গলাটাকে যথা সম্ভব আয়ত্তে এনে সে বলল “বাবু ডাকতিসেন?” দুর্জয় কানে শুনতে পাচ্ছেন না দুই দশক হতে চলল। কিন্তু সেটা টের তিনি পান না। তবে বাবুরাম থেমেছে। মাথা তুলে চেয়েছে। মুখ ও নেড়েছে। “সিঁড়ির দরজায় আগল দেওয়া নেই, একটিবার আয় বাবা?” বাবুরাম গরীব। অগত্যা।
তেতলায় উঠতে এই বয়সেও হাঁপ ধরে না বাবুরামের। আধা ভেজানো দরজা খুলে বসার ঘরে ঢুকল সে। গতিক ভালো ঠেকল না। সুবিধের মানুষ বলে বাজারে বিশেষ সুনাম দুর্জয় বাহাদুরের নেই। ইদানীং বড্ড বাড় বেড়েছেন। বলিহারি শখ চাপে, আর মাথা কাটা যায় বাবুরামের। প্রিয় ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে মেঝেতে বাবু হয়ে বসল বাবুরাম। গোল সোনালি ফ্রেমের চশমাটায় “হাহ!” করে এতখানি মৌখিক বাষ্প ছেড়ে ফতুয়ার খুঁট দিয়ে সেটা মুছতে উদ্যত হলেন দুর্জয়। বাবুরাম ডাইনে বামে তাকাল, নাক খুঁটল, তারপর অ্যাশট্রেটা চালান করল ঝোলায়। বাহারি জিনিস, দু’পয়সা আসবে। চশমাটা কানে গুঁজে দুর্জয়বাবু কাউচে অবস্থান করলেন। বোমাটা পড়ল বলে। বাবুরাম আঁচ করতে থাকে। ডাগর মেয়েমানুষ? গেল পূর্ণিমার এক হপ্তা আগে নেকড়ে চেয়ে বসেছিলেন দুর্জয়। নেকড়ের বাচ্চা। তারা নাকি তেমন তেমন পূর্ণিমায় মানুষ হয়ে যায়। এবার কী?
“দিন দিন দুনিয়ায় দুষ্টের সংখ্যা বাড়ছে বাবুরাম। বিহিত চাই। স্বহস্তে ইয়ে দমন। দুর্জয়ম্যান। নিদেনপক্ষে এমএলএ দুর্জয়। বুঝলি?”
বাবুরাম সভয়ে মাথা নাড়ল। সে বোঝেনি।
“আমায় কিছু দুষ্ট এনে দে। ভয়ানক কিছু।”
বাবুরাম আবার মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে।
” জঙ্গি এনে দি কর্তা? শস্তা যাচ্ছে বেশ। নারকেলডাঙার বাজারেই দেখছিলাম…”
দুর্জয় শঙ্কিত হলেন। “ওরে না না। জঙ্গি উগ্রপন্থীরা কামড়ে দেয় শুনেছি। ইবোলা কি জিকা ভাইরাস ধরবে শেষে। কী দরকার? আর কী কী আছে রে?”
বাবুরাম মুচকি হাসে। “কালোবাজারি আনি? বোয়াল সাইজের লুটেরা বাবু, তাজা হবে…”
দুর্জয় ভুরু কুঁঁচকালেন। “ছোঃ ওটা আবার কোনও ক্রাইম হল? নে নে ভালো করে দেখা দিকি আর কী আছে?”
বাবুরাম নড়েচড়ে বসল। স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট। “অনেক কটা ইয়ে আছে। রেপ। রেপ। রেপ করে যারা। অর্ডারি মাল। বললে ডিসকাউন্টে আনিয়ে দেব।”
দুর্জয় ফতুয়া টেনে কাছা ঠিক করে পিছন আড়াল করে বসলেন। “না। ওগুলো না। ভয় করে।” মিনমিন করে বললেন তিনি।
বাবুরাম চটে যায়। ছোটুলালের ভাষায় খচে বোম। “কী চান বলেন দিকি পষ্ট করে তবে।”
দুর্জয় এদিক ওদিক চোখ চালিয়ে নেন। “আরে। বেশি নখ দাঁত থাকবে না, বুঝলি? বেশি দৌড় করাবে না। নো ফোঁসফাঁস নো উৎপাত। সেইরকম একটা কিছু। বুঝলি। কিন্তু জ্যান্ত হওয়া চাই।”
বাবুরাম বিজ্ঞের মোট মাথা নাড়ে। “সেটা আগে বললেই হত। জলের দরে বিকোচ্ছে। ইস্টুডেন্ট। ছাত্তর। কলেজের। যাদবপুর না কোথায়? মেলা পাওয়া যায়। আনা করাই?”
দুর্জয় প্রসন্ন হাসেন।