দুই মাথার মোড় হয় না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তিন থেকে গোনা শুরু, এক দুই এর বালাই ই নেই। আবার তিন মাথা বললেও কেমন একটা লাগে। একটা রাস্তা অন্য রাস্তায় মিশেছে। ওইটুকুই তো। না ওইটুকু নয়। দুইখানা রাস্তা মিশে গিয়ে তৃতীয় রাস্তা একটা তৈরী করতে পারে না?

সেরকমই একটা তিনমাথার মোড়ে নিজেকে আবিষ্কার করল ইলা। মুশকিল হচ্ছে কোন ধারাটা দিয়ে সে বয়ে এসেছে সেটা মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না কোনদিকে যেতে হবে। মোড়ের মধ্যের ছোট্ট তেকোণা দ্বীপটায় দাঁড়িয়ে সে রাস্তাগুলোর নামকরণ করল। করল, কারণ সে দোকানে লেখা হরফগুলো পড়তে পারছে না, এ ভাষা তার অজানা। ইলা পূব দিকের রাস্তাটার নাম দিল নতুন গীর্জা সরণী। নতুন বা পুরোনো কোনও গীর্জাই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু যদিও, তবে ইলা দুটো শববাহী গাড়ি আসতে দেখেছে ওইদিক থেকে, আর একটা সদ্য বিবাহিতদের গাড়ি। নতুন গীর্জা সরণী যেখানে এসে শেষ, সেখানে একটা রঙচটা ছাইরঙা তিনতলা বাড়ি। সরাইখানা। একটা বাহারি গাছ লতিয়ে উঠেছে তাতে। রাস্তামুখী জানালা গুলো বন্ধ, ওপারে সাদা পর্দা দৃশ্যমান। আর অন্যদিকের জানালাগুলোর সামনে বোগেনভিলিয়ার টব রাখা। সেই ছাই-বাড়ির একতলায় একটা ছোট্ট রেস্তোরা। ফুটপাথে চারটে চৌকো টেবিল, আর আটটা চেয়ার, আর একটা ছাউনি। তাতে কেউ বসে নেই এখন। ইলার খিদে পেয়েছে।

গীর্জা সরণী আর সুঁড়িখানাবীথির মাঝখানে জলজ্যান্ত একটা গেলবার জায়গা। তার কাঁচের জানালায় বিস্তর রঙিন বোতল, আর বাইরে একটা কাঁচা হাতের আঁকা নগ্নিকা। ইলা নগ্নিকা আঁকতে ভালোবাসে। ইলা এর থেকে অনেক ভালো আঁকে। ইলা পান করতেও পছন্দ করে, কিন্তু এখন বড্ড সকাল। রাতের অতিথিরা খোঁয়ারি ভেঙে বেরিয়ে আসছে একে একে, সকালটার ঔজ্জ্বল্য তাদের ধাঁধিয়ে দিচ্ছে খানিক, হাত দিয়ে সূর্য্য আড়াল করে অগোছালো মাতালরা বাড়ি ফিরছে। পানশালার সামনেই বাতিস্তম্ভে হেলান দিয়ে ঘুমটুকু পুরিয়ে নিচ্ছে একজন, হয়ত কাল রাত থেকেই। ইলার ঘুম পেয়েছে।

তৃতীয় রাস্তাটার নাম ছায়াপথ ছাড়া কিছু হতেই পারে না। এ রাস্তার দু’পাশ জুড়ে পিপুল গাছ বংশ এবং শাখা বিস্তার করে রেখেছে। রাস্তাটা ইলার দীর্ঘ একটা সুড়ঙ্গের মত লাগে। অন্য দু’টো রাস্তা শহরের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, পাথর বসানো রাস্তা, দু’পাশে সারি দেওয়া বাড়ি। হেলান দিয়ে রাখা সাইকেল। ছায়াপথ একটু এগিয়েই মাটি নিয়েছে। এটা তার মানে শহরের একটা প্রান্ত, ইলা ভাবে, ছায়াপথ দিয়ে তার প্রবেশ। কিন্তু ইলার মনে নেই, তার শহরে ঢুকবার কথা, নাকি প্রস্থান করবার।

ছায়াপথ আর সুঁড়িখানাবীথির মাঝখানে ইলা একটা স্টুডিও দেখতে পায়। অবাক হয়। পান্থশালার মানে আছে, পানশালাও বোঝা যায়। কিন্তু তাই বলে শহরের প্রান্তে ছবিঘর? ছবি তোলাতে এতদূর কে আসবে? উৎসুক হয় ইলা। ব-দ্বীপ থেকে হেঁটে রাস্তা পেরোয়, অবারিত দ্বার। দরজার উপরে একটা কিছু বড় হরফে লেখা। জ্বলজ্বল করছে। ভিতরে ঢুকল ইলা। কই, কেউ নেই তো? দেওয়ালে হাজারো হাসিমুখের ছবি। সামনের কাঁচের টেবিলের উপর তারিখ দিয়ে খাম সাজানো। শেষটা সতেরোই। উচিৎ নয়, ইলা, ঠিক হবে না কাজটা। কিন্তু কৌতূহলের কাছে ঔচিত্যবোধ কবে জিততে পেরেছে? এদিক ওদিক দেখে খাম থেকে ছবিগুলো বের করে দেখতে থাকে সে। এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তোলা প্রত্যেকটা ছবি। ইলা চিনতে পারে। বাইরের মোড়ের ব-দ্বীপটায় দাঁড়ানো সকলে, পিছনে ছায়াপথ। প্রত্যেক খামের ছবিগুলো আবার সকাল থেকে রাতের ক্রমান্বয়ে সাজানো। সাধারণ মুখ গুলো, বড় সাধারণ, তবু কী নেশায় সে উল্টে দেখতে থাকে…

চোদ্দ তারিখের বারো নম্বর ছবিটায় থমকে গেল ইলা। যাবারই ছিল, নইলে গল্পটা মিছিমিছি এতদূর এগোলই বা কেন? ছবিটা প্রায়-সন্ধের। ছবিটা ইলার। ছবিতে সে একই পোশাক পরে রয়েছে সে। ছায়াপথে সূর্যাস্ত হচ্ছে। মুখে হাসি ফোটে ইলার। এ শহরে সে চোদ্দ তারিখ এসেছিল। সুঁড়িখানাবীথি অথবা নতুন গীর্জা সরণী ধরে সে আবার এই মোড়ে পৌঁছেছে।

এখন যাবার সময়। ইলা ছায়াপথের দিকে পা বাড়ায়।