সুজন ফট করে মরে গেল।
এই গতকালই আইসক্রিমের কাঠিচামচ দিয়ে ভাঁড় থেকে রসমালাই খুঁটে খাচ্ছিল, তারপর আজ মরে গেল। খুবই সামান্য, স্বাভাবিক মৃত্যু। সেরকম ঘটনাবহুল নয়, চাঞ্চল্যকর কিছু ছিল না তাতে। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে মিনিবাস চাপা পড়েনি, মেট্রোয় ঝাঁপ দেয়নি, ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েনি, বিষ খায়নি, কঠিন কোনও অসুখ তার ছিল না। স্রেফ মরে গেল। তপসিয়ায় দিদুনের বাড়ি গিয়েছিল বিকেল করে, ঘণ্টা দেড়েক থেকে উঠি উঠি করছিল। কাজ ছিল না তেমন, মাসের ওষুধটা দিল, আর যত আজাইরা কথা। উঠেই পড়ল শেষ পর্যন্ত, বলল “এবার তাহলে আসি?”। তারপরেই মরে গেল। সাবধানে যেতে বলেছিল দিদুন। সে সাবধানেই গেছিল, তবে সোজা পথে নয়। চৌরঙ্গীতে মস্ত ঢ্যাঙা একটা বাড়ি হচ্ছে, চারু মার্কেট থেকেই দেখা যায়, তার ঠিক তলায় দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে উপর অবধি দেখল সুজন। বিড়বিড় করে আশীর্বাদ দিল কি? জাকারিয়া স্ট্রিটে হাঁটল খানিক, খেলো না কিছু। গোরস্থানের পাশ দিয়ে অটোতে বেরিয়ে গেল, ঢুকল না। সুজন গোরস্থানে ঢুকল না! সুজন শোভাবাজারে রঙিন গলির সামনে দাঁড়াল, অসঙ্কোচে হেঁটে গেল সায়া- ব্লাউজদের মধ্যে দিয়ে। বাকি ছিল। হেঁটে যাওয়াটুকু বাকি ছিল। একজন হিজড়ে পথ আটকে দাঁড়াল তার, বেরোবার মুখে, সঙ্গিনী বেশ্যাটি তার গাল টিপে দিল। আজ ভয় পেলো না সুজন, জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিল না, নিরুপায় হয়ে দশটাকা দিয়ে নিষ্কৃতি কিনল না। হাসল। “ভালো থেকো তোমরা”, সে বুকে জড়িয়ে ধরল তরুণী বেশ্যাটিকে। জীবনের প্রথম আলিঙ্গন পেল কুমারী।
তারপর বাড়ি ফিরল সুজন। দরজায় তালা দিয়ে মরে গেল।
ময়নাতদন্ত নামটা খুব অদ্ভুত। ময়না। অন্ধকারে অদৃশ্যপ্রায়। গলা শুনে বোঝবার উপায় নেই। রাতের বেলায় অভিজ্ঞ কান চেনে শুধু। পোস্টমর্টেম বইতে লেখা বিজ্ঞান, ওতে কি আর আর সব ধরা পড়ে? পড়েনি। সময়টুকু জানা গিয়েছিল শুধু। স্বাভাবিক মৃত্যু, মাথা নেড়ে ডাক্তার বলেছিল। ঝুপ করে দৈহিক ক্রিয়া বন্ধ, ফুলস্টপ। কেন? ময়নাতদন্তের প্রয়োজন, সুজন কেন মরল জানতে। কার শ্রবণ অত তীক্ষ্ণ?
 
জানা গেল না। কেবল জানা গেল সুজন বাড়ি ফিরে দরজায় তালা দিয়েছিল। হলুদ ঢোলা টিশার্ট ছেড়ে সাদা ঘরের জামা গলিয়ে নিয়েছিল গায়ে। আর কোমরে ঢিলে পকেট ছেঁড়া হাফপ্যান্টটা। পাখা চালিয়ে পায়ের দিকের জানালাটা খুলে খয়েরীর উপর সাদা ফুল ফুল চাদরটা টেনে শুয়ে পড়েছিল। জানা গেল না “কাল একবার ব্যাঙ্কে যেতে হবে”, ভেবেছিল কিনা সুজন। হয়ত যাওয়ার ছিল না আর কোথাও। ব্যাঙ্কে না, রাণীকুঠিতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বিল জমা দিতে না, দাঁতের এক্স রে করাতে না, পার্ক সার্কাস ময়দানে অপেক্ষা করতে না। হয়ত সুজনের আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।
 
জানা গেল না সুজন আর একটু ঘুমোতে চেয়েছিল কিনা? আর একটু, আরও একটু।